হবিগঞ্জের মূল্যহীন জমি এখন সোনা, এক দশকে দাম বেড়েছে ৩০০ গুণ
গ্যাস-বিদ্যুতের সহজলভ্যতা, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত জনবল আর কম মূল্যের জমির কারণে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ ও মাধবপুর উপজেলায় নজর পড়ে দেশের শিল্প উদ্যোক্তাদের। একের পর এক বহুজাতিক রপ্তানীকারক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কারণে ওই এলাকার জমির দাম গত এক দশকে বেড়েছে ৩০০ গুণ।
এমনকি মহাসড়কের পাশে এখন কেনার মতো জায়গাই মিলছে না। মহাসড়ক থেকে এক-দেড় কিলোমিটার দূরের জমি কিনতেও বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে। সেইসাথে নবীগঞ্জ ও বাহুবল উপজেলায় মহাসড়কের পাশেও উচ্চ মূল্যে চলছে জমি বেচা-কেনা।
রাজধানী ঢাকার সাথে সিলেটের সড়ক যোগাযোগ সহজ করতে ২০০৩ সালে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক নির্মাণ করে সরকার।
দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ২০১০ সালে হবিগঞ্জের ওলিপুরে প্রথম অল্প কিছু জমি কিনে। ২০১৪ সালে ২২০ একর এলাকাজুড়ে 'হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক' গড়ে তোলে তারা।
এরপর থেকে একের পর এক শিল্পপ্রতিষ্ঠান মালিকদের নজর পড়ে এখানে। জমি কেনার প্রতিযোগিতা শুরু হলে রকেট গতিতে বাড়তে থাকে জমির দাম।
বর্তমানে শায়েস্তাগঞ্জের ওলিপুর থেকে মাধবপুর উপজেলা সদর পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দুই পাশে গড়ে উঠেছে শতাধিক শিল্পকারখানা।
সেখানে বিশাল এলাকা নিয়ে প্রাণ-আরএফএল, স্কয়ার, যমুন গ্রুপ, সায়হাম গ্রুপ, বাদশা টেক্সটাইলস্সহ বিভিন্ন বহুজাতিক রপ্তানিকারক শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের কারখানা গড়ে তুলেছে। দেশি কোম্পানির পাশাপাশি বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানিও বেছে নিয়েছে এই এলাকা।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৫ বছর আগে মহাসড়কের দুপাশের জমিগুলো ছিল মূল্যহীন। কিছু জমি অনাবাদি আর কিছু জমিতে শুধুমাত্র রোবো ধান ছাড়া অন্য কোন ফসল উৎপাদন হতো না। বিক্রি করতে গেলও মিলত না ক্রেতা। জমির মূল্যও ছিল নামমাত্র।
২০১২ সালের আগ পর্যন্ত এই এলাকার জমি বেচা-কেনা হতো 'কের' হিসেবে। ৩২ শতকে এক কের ধরা হয় এই এলাকায়। মহাসড়কের পাশে ১ লাখ, আর একটু দূরের হলে বিক্রি হতো ৮০ হাজার টাকা কের।
২০১০ সালের প্রাণ আরএফএল গ্রুপ যখন জমি কিনে তখন সহযোগিতা করেছেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী বেলাল।
তিনি বলেন, "প্রাণ আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেব এই এলাকায় জমি কিনতে চান বলে আমাকে জানান। তখন আমি উনাকে আশ্বস্ত করলাম জমির ব্যবস্থা করে দেব বলে। স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা বললাম তারা সহজেই জমি দিতে রাজি হয়ে গেল। পরে ওলিপুরে অল্প অল্প করে প্রাণ আরএফএল গ্রুপ জমি কিনতে শুরু করল।"
২০১০ সালে প্রাণ আরএফএল গ্রুপের কাছে জমি বিক্রি করেছিলেন সুচিউড়া গ্রামের বসিন্দা ও আমরোড হাই স্কুল এন্ড কলেজের সহকারি প্রধান শিক্ষক আবু মো. জাকারিয়া।
তিনি বলেন, "মহাসড়কের পাশের জমিগুলো খুবই নিচু ছিল। কিছু কিছু জমিতে বোরো আবাদ হলেও অনেকগুলো পতিত পড়ে থাকত। কোমর পর্যন্ত দেবে যাওয়ার কারণে হালচাষও করা যেত না। তাই জমির দামও কম ছিল। এক লাখ টাকা কের বিক্রি হতো তখন। অথচ বর্তমানে এই এলাকায় জমি বিক্রি হয় ৮/১০ লাখ টাকা শতক।"
ওলিপুর এলাকার জমির মালিক ও স্থানীয় ব্যবসায়ি মো. মজনু মিয়া বলেন, "মহাসড়কের পাশে এখন কেনার মতো তেমন জায়গা নেই। দেখবেন অনেক জায়গা ফাঁকা রয়েছে, কিন্তু সেগুলোও কোন না কোন কোম্পানি কিনে নিয়েছে।"
"সময়-সুযোগ অনুযায়ী তারা কারখানা করবে অথবা কয়েকগুণ বেশি দামে অন্য কোন কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিবে। আবার কিছু কিছু জায়গা কারখানা করার উপযুক্ত না হওয়ায় বা জায়গার মালিক বিক্রি করতে না চাওয়ায় হয়তো খালি পড়ে রয়েছে," যোগ করেন তিনি।
বিভিন্ন কোম্পানিকে জায়গা কিনতে সহযোগিতা করে স্থানীয় কয়েকটি সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ওলিপুর এলাকায় মহাসড়কের পাশে বর্তমানে ৮/১০ লাখ টাকা শতক বিক্রি হচ্ছে। আবার শাহজীবাজার বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা গ্যাস ফিল্ডের কাছে হলে প্রতি শতকে দাম বাড়ে এক থেকে দেড় লাখ। মহাসড়ক থেকে এক-দেড় কিলোমিটার দূরে বিক্রি হয় ৫/৬ লাখ টাকা শতক। আর জমির পাশে পাকা রাস্তা থাকলে ৭ থেকে সাড়ে ৭ লাখ।
রাজিউড়া এলাকার বাসিন্দা ও ওলিপুর বাজারের ব্যবসায়ি মো. আনিসুর রহমান আনিস বলেন, "ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক বা আঞ্চলিক সড়কের পাশে ছোট কিছু জায়গা আছে, সেটি কোন কোম্পানি কিনতে চায় না। সেই জায়গার দাম আরও বেশি হয়। সেখানে ভবন নির্মাণ করে নিচ তলায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও উপরে বাসা ভাড়া দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি লাভবান হতে পারেন ক্রেতা। আবার যত টাকা দিয়ে জায়গা কিনেছেন এর অর্ধেক টাকা ভাড়া দেওয়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সিকিউরিটি বাবদ নিতে পারছেন।"
হবিগঞ্জ জেলা রেজিস্টার মো. মিজানুর রহমান বলেন, "শায়েস্তাগঞ্জের ওলিপুর মৌজায় ফসলি জমির সরকারি সর্বনিম্ন মূল্য ৮ হাজার ৬৫৪ টাকা থেকে ৭৪ হাজার ৭১৫ টাকা। কিন্তু মূলত ওই এলাকায় জমি কয়েক লাখ টাকা শতক মূল্যে বিক্রি হচ্ছে।"
তিনি আরো বলেন, "যেহেতু সেখানে বিভিন্ন ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠছে সেহেতু জমির মূল্য বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। তবে যে মূল্যে জমি কেনা-বেচা হয় সেই মূল্যে জমি রেজিস্ট্রি করা হয় না। সরকারি ভ্যাট ফাঁকি দিতে ক্রেতা-বিক্রেতা সমন্বয় করে দলিলে একটি মূল্য লিখে দেয়।"
তিনি বলেন, "জমি বেচা-কেনার ক্ষেত্রে নতুন আইন হচ্ছে। এই আইনে হয়তো ভূয়া মূল্য দেখিয়ে রেজিস্ট্রি করার সুযোগ নাও থাকতে পারে।"