আমেরিকার আকাশে কি ঘটছে? তত্ত্ব আছে, তবে রহস্যময় বস্তু ভূপাতিত করার উত্তর নেই!
গত শুক্র, শনি ও রোববারে আলাস্কা, কানাডা ও মিশিগানের আকাশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তিনটি অপরিচিত উড়ন্ত বস্তু (ইউএফও) মিসাইল নিক্ষেপ করে ভূপাতিত করেছে।
সর্বশেষ বস্তুটি শনিবার প্রথমবারের মতো মন্টানার আকাশে অবস্থান করার কথা জানা যায়। প্রথমে রাডারে কোনো সমস্যা হয়েছে বলে ভেবেছিলেন মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা। কিন্তু রবিবার মন্টানা, উইসকনসিন ও মিশিগানের আকাশে রাডার অপরিচিত বস্তুর সংকেতের কথা জানান দেয়।
বস্তুটিকে প্রত্যক্ষ করে এটির অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর সামরিক কর্মকর্তারা এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে এটিকে লেক হুরনের ওপর ভূপাতিত করার আদেশ দেন।
আপাতত দুটো বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে: ওই উড়ন্ত বস্তুগুলো কী ছিল? এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেনই বা এগুলোকে হঠাৎ করে দেখতে পাচ্ছে এবং অনেকগুলোকে ভূপাতিত করছে?
প্রথম প্রশ্নের কোনো উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। মার্কিন কর্মকর্তারা এসব বস্তু কী সেটাই জানেন না, এগুলোর উদ্দেশ্য বা কারা পাঠিয়েছে তা জানা তো আরও দূরের কথা।
দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, এখনো পরিষ্কারভাবে এটা জানা যায়নি যে এ বন্তুগুলোর সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছে কিনা। তবে একথা নিশ্চিত যে, চীনের গোয়েন্দা বেলুনকাণ্ডের পর যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সশস্ত্র বাহিনী এখন তাদের আকাশে এমন সব বস্তুকেও চিহ্নিত করতে শুরু করেছে যেগুলো নিয়ে আগে হয়তো মাথা ঘামাত না।
এ মাসে চীনের বেলুন মার্কিন আকাশে প্রবেশের পর নর্থ আমেরিকান অ্যারোস্পেস ডিফেন্স কমান্ড তথা নোরাড এর রাডার ব্যবস্থাকে আরও সংবেদনশীল করে তুলেছে। এর ফলে এ রাডার সিস্টেমের আকাশে বস্তু চিহ্নিত করার পরিমাণ আগের তুলনায় বেড়ে গিয়েছে।
তবে এ ধরনের আরও বস্তু যে থাকতে পারে, এমন সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেননি মার্কিন কর্তৃপক্ষ। কেউ কেউ মনে করছেন, মার্কিনীদের শনাক্ত করার সক্ষমতা পরীক্ষার জন্য এ অজানা বস্তুগুলো হয়তো চীন বা অন্য কোনো বিদেশি শক্তি থেকে পাঠানো হয়েছে।
অষ্টভুজাকৃতির বস্তুটি মার্কিন নাগরিকদের জন্য বিপজ্জনক দাবি করে এটিকে ভূপাতিত করে বাইডেন প্রশাসন। কানাডাও জানিয়েছে, ওই বস্তুটি গোয়েন্দা বেলুনের চেয়ে নিচু হয়ে উড়ছিল। ফলে এটি বেসামরিক বিমানের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছিল।
মার্কিন কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা এখনো এ তিনটি বস্তু কী ছিল তা জানার চেষ্টা করছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেছেন, প্রথম বস্তুটি কোনো বেলুন ছিল না এবং আঘাত করার পর এটি কয়েক টুকরো হয়ে গিয়েছিল।
শনিবারে ভূপাতিত করা বস্তুটিকে কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষ সিলিন্ডারের মতো বলে বর্ণনা করেছে। কিন্তু মার্কিন কর্তৃপক্ষের ধারণা, এটি খুব সম্ভবত একটি বেলুন ছিল। আর সর্বশেষ রোববারের বস্তুটি বেলুনজাতীয় কিছু নয় বলে জানিয়েছেন আরেক মার্কিন কর্মকর্তা।
প্রথম দুটি বস্তুকে ভূপাতিত করার আগে প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে এগুলোকে ট্র্যাক করেছিল নোরাড। একজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ বস্তুগুলো কী উপায়ে আকাশে ভেসে ছিল এ বিষয়েও তাদের কাছে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই।
ধ্বংস করার আগে মার্কিন পাইলটেরা বস্তুগুলোকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তাদের বিমান থেকে ধারণ করা ভিডিও ও সেন্সর রিডিং পর্যবেক্ষণ করছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। তবে এফবিআই ও রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ এগুলোকে সম্পূর্ণভাবে পরীক্ষা করার আগ পর্যন্ত বিস্তারিত কিছু জানানো হবে না।
বস্তুগুলোর উৎপত্তি সৌরজগতের বাইরে, এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন কিনা — রোববার সংবাদ সম্মেলনে এ প্রশ্ন করা হলে মার্কিন বিমান বাহিনীর নর্দার্ন কমান্ডের কমান্ডার জেনারেল গ্লেন ডি. ভ্যানহার্ক বলেন, 'আমি এ পর্যায়ে কোনো সম্ভাবনাকেই উড়িয়ে দিচ্ছি না।'
তবে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা মনে করছেন, এলিয়েনের দুনিয়া নয় বরং আমাদের গ্রহেই এ বস্তুগুলো তৈরি করা হয়েছে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত পেন্টাগনের ইউএফও প্রোগ্রাম পরিচালনা করা সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা লুই এলিজন্দোও এ ভাবনার সঙ্গে একমত।
বেশ কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো স্বল্প-প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্র মার্কিন আকাশে পাঠিয়েছে। এলিজন্দো মনে করেন, ধ্বংস করা বস্তুগুলোও আদতে এ ধরনের গ্যাজেট যেগুলো দিয়ে আমেরিকাকে হয়রানি করা হচ্ছে।
গত মাসে প্রকাশিত একটি পাবলিক রিপোর্টে মার্কিন গোয়েন্দা দপ্তরগুলো জানিয়েছে, ৩৬৬টি এ ধরনের ব্যাখ্যাহীন ঘটনার ক্ষেত্রে ১৬৩টি পরে বেলুন বলে জানা গিয়েছে। এগুলোর মধ্যে দুটো ঘটনা চীনের তৈরি কোনো অত্যাধুনিক আকাশযান প্রযুক্তি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট আরেকটি গোপনীয় প্রতিবেদনে জানা গেছে।
মার্কিন আরেকজন কর্মকর্তা আরেকটি তত্ত্বের কথা বলেছেন। তার ধারণা, রাশিয়া ও চীন এসব বস্তু পাঠিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের সক্ষমতাকে যাচাই করতে। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, এটা স্রেফ একটি তত্ত্বই।
মার্কিন কর্মকর্তারা একটি বিষয়ে একমত। তা হলো, চীনের ওই বেলুনটি আদতেই গোয়েন্দা বেলুন ছিল যা দিয়ে চীন মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর নজরদারি করতে চেয়েছিল। তারা আরও জানিয়েছেন, ওই বেলুনের নিজেকে ধ্বংস করার ক্ষমতা ছিল।
গত বছর কলোরাডোতে অ্যাসপেন সিকিউরিটি কনফারেন্স-এ বক্তৃতা দেওয়ার সময় জেনারেল ভ্যানহার্ক বলেন, নিজেদের আকাশসীমায় কিছু বস্তু শনাক্ত করতে বিভিন্ন সময়ে বেগ পেতে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রকে। নোরাডের রাডার পর্যাপ্তভাবে হাইপারসনিক মিসাইল ও অন্যান্য হুমকি চিহ্নিত করতে পারেনি।
তবে তিনি আরও জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সম্ভাব্য হুমকি শনাক্ত করতে নতুন ধরনের ওভার-দ্য-হরাইজন রাডার তৈরির চেষ্টা করছে। একই লক্ষ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাতেও বিনিয়োগ করেছে দেশ দুটি।
সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস