ডিম-মুরগির দাম চড়া, নিম্ন আয়ের মানুষের প্রোটিন খাবারে কাটছাঁট
খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা আল-আমিন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। চার সদস্যের পরিবারে প্রতিদিন সকালে চারটি সেদ্ধ ডিম খাওয়ার অভ্যাস গড়েছেন। কিন্তু বাজারে ডিম, মুরগি, সবজি থেকে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ডিম খাওয়ার এই অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে হয়েছে তাকে। এখনো তিনি ডিম খান তবে প্রতিদিন নয়, মাঝেমধ্যে যখন তরকারি হিসেবে ডিম রান্না হয় তখন।
সাধারণ মানুষের প্রোটিনের সবচেয়ে সস্তা ও বড় উৎস হিসেবে যখন ব্রয়লার মুরগি ও ডিম জনপ্রিয় ঠিক তখনই হু হু করে বাড়ছে পণ্য দুটির দাম। দাম বৃদ্ধি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মানুষ তার খাবার মেন্যু থেকে সস্তা প্রোটিনের উৎসটিতেও কাটছাঁট করছে।
ঢাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১২৫-১৩০ টাকায়। পাশাপাশি ব্রয়লার মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৪৫ টাকা ডজন হিসেবে। ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বৃহস্পতিবারের বাজার বিশ্লেষণের তথ্য বলছে, এক বছর আগের তুলনায় ব্রয়লার মুরগির দাম প্রায় ৩৯ শতাংশ এবং ডিমের দাম ৩০ শতাংশ বেশি।
কারওয়ান বাজারের সততা মুরগির আড়তের বিক্রেতা মো. সুমন জানান, "সরবরাহ অবস্থা যে পর্যায়ে গেছে, তাতে রমজানে হয়তো দামটা আরও বাড়তে পারে।"
ভোক্তারা বলছেন, ডিম ও মুরগির দাম এমন একটা সময়ে বাড়লো যখন কিনা বাজারে সব ধরনের ভোগ্যপণ্য কিনতে হচ্ছে উচ্চমূল্য দিয়ে। এতে করে মানুষকে বাধ্য হয়েই খাবার মেন্যুতে কাটছাঁট করতে হচ্ছে।
আল-আমিন টিবিএসকে বলেন, "ব্রয়লার মুরগি ও ডিম ছিল একটা বড় ভরসার জায়গা যখন কিনা বাজারে চাল, তেল, ডাল, চিনি, মাছ থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্যের দামই চড়া। ফলে খাবার মেন্যুতে কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছি, কারণ প্রায় তিন বছর ধরে আমার আয় আগের অবস্থাতেই আছে।"
খাবারের দাম বেশি হওয়ার কারণে মানুষ যে খাবার মেন্যুতে কাটছাঁট করছে তার আরও একটি প্রমাণ মেলে বাড্ডার মুদি দোকানি আলতাফ মাহমুদের কথায়। তিনি বলেন, আমার ছোট্ট মুদি দোকানে প্রতিদিন ২৫০-৩০০ পিস ডিম বিক্রি হতো। এখন দাম বেশি হওয়ার কারণে ডিমের বিক্রি ১৫০-২০০ এর মধ্যে নেমে এসেছে।
সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারের রূপালি ব্রয়লার হাউজের বিক্রেতা খোরশেদ আলম টিবিএসকে বলেন, "ক্রেতার কাছে যখন ব্রয়লার মুরগির দাম ২৩০ টাকা চাচ্ছি তখন অনেকে মাংস না কিনেই চলে যাচ্ছেন। আবার অনেক পরিচিত ক্রেতা আছেন যারা ৩-৫ কেজি মাংস কেনে একসঙ্গে, তারা ২ কেজির বেশি নিচ্ছেন না।"
তিনি জানান, "একটু গরিব শ্রেণীর যেসব ক্রেতা দোকানে আসতো তারা এখন আর ব্রয়লার মুরগি কিনছেন না।"
কেন দাম বাড়ছে
ব্রয়লার মুরগির উৎপাদনকারী খামারিরা বলছেন, বর্তমানে মুরগির উৎপাদন খরচ ১৪৮ টাকা সর্বোচ্চ। প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ দাঁড়িয়েছে ১১.১১ টাকায়। গবেষক দিয়ে হিসেব করে এই উৎপাদন খরচ বের করেছে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)।
তাদের মতে, উৎপাদন খরচ এত বেশি হওয়ার মূল কারণ ফিডের মূল্যবৃদ্ধি। এক বছর আগে যে ফিড কিনতে খরচ হয়েছে সর্বোচ্চ ২৯০০ টাকা (৫০ কেজি), সেটায় এখন লাগছে ৩,৬৫০ টাকা। ফিড কোম্পানিগুলো গত ৯ ফেব্রুয়ারি তারিখেও কেজিতে দুই টাকা করে দাম বাড়িয়েছে।
এছাড়া একেকটি ব্রয়লার মুরগির একদিনের বাচ্চার উৎপাদন খরচ ২৫-৩০ টাকার মধ্যে, যেটি এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। এছাড়া বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, ঔষধের বাড়তি মূল্যও এই উৎপাদন খরচে যোগ হয়েছে।
বর্তমান যে দামে ডিম ও মুরগি বিক্রি হচ্ছে এই দামটা মোটেও স্বাভাবিক নয় বলে দাবি করছেন খামারিদের সংগঠন বিপিএ-এর সভাপতি সুমন হাওলাদার।
তিনি টিবিএসকে বলেন, ভোক্তা পর্যায়ের মুরগির এই দামটা মোটেও যৌক্তিক নয়। খামারিরা ১৮০-১৯০ টাকা কেজি দরে মুরগি বিক্রি করছেন, এটাও যৌক্তিক দাম না।
সুমন হওলাদার বলছেন, ১৫০ টাকা উৎপাদন খরচ দিয়ে ১৬০-১৬৫ টাকা খামারি পর্যায়ে এবং ১৮৫-১৯০ টাকা ভোক্তা পর্যায়ে থাকলে সেটাকে স্বাভাবিক বলা যায়।
খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ফিডের বিভিন্ন কাঁচামালের আমদানি সংকুচিত হয়ে পড়ে এবং দামও বেড়ে যায়। যে কারণে ফিডের মূল্য দফায় দফায় বাড়ায় ফিড মিলগুলো। এতে করে বেড়ে যায় উৎপাদন খরচ। কিন্তু খামারিরা বাজারে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে মুরগি বিক্রি করতে থাকে। তারা জানান, বছরখানেক আগেও যখন মুরগির উৎপাদন খরচ ছিল ১৪০ টাকার মতো, তখন খামারিরা ১২০ টাকার বেশি দাম দিয়ে মুরগি বিক্রি করতে পারেনি।
দীর্ঘদিন এই লোকসান গুনে খামারিরা ব্যবসা ছেড়ে দেয়। বিপিএ বলছে, সারাদেশের ১.৬ লাখ খামারির মধ্যে এখন ৬০ হাজারের বেশি খামারে উৎপাদন নেই। যখন খামারিরা উৎপাদন বন্ধ করে দেন, তখন একদিনের মুরগির বাচ্চা বিক্রি করতে না পেরে হ্যাচারির মালিকরা ডিম নষ্ট বা বিক্রি করতে শুরু করে দেন। বাচ্চার দাম নেমে আসে ৯ টাকায়, যা বিক্রি করতে গেলেও উৎপাদনকারীর লোকসান হয়, কারণ এর খরচই ২৮-২৯ টাকা।
আফতাব বহুমুখী ফার্মসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু লুৎফে ফজলে রহিম খান বলেন, ২০১৯ সালের তৃতীয় প্রান্তিক থেকে এ বছরের জানুয়ারী পর্যন্ত একটা দীর্ঘ সময়জুড়ে এই শিল্পে উৎপাদন ১৫% থেকে ২৭% পর্যন্ত চাহিদা অতিক্রম করে। ফলে খাত সংশ্লিষ্ট অনেকেই তখন বেরিয়ে গেছে, যা আজকের এই সরবরাহ ঘাটতির পরিস্থিতিতে অবদান রেখেছে।
"২০২২ সালের মার্চ থেকে ফিড ইন্ডাস্ট্রি সমস্যায় পড়েছে, এর আগে পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিল না", বলেন তিনি।
বিপিএ'র সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, "কখন দামটা বাড়ছে খেয়াল করলেই বোঝা যাবে। যখন খামারিদের কাছে উৎপাদন নেই, কিন্তু কর্পোরেট ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কন্ট্রাক্ট ফার্মারদের কাছে উৎপাদন রয়েছে, যার মাধ্যমে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাজার দখলে রাখে। সুযোগ বুঝে এখন তারা ব্যবসা করে নিচ্ছে, ইচ্ছেমত দাম বাড়াচ্ছে। আবার খুচরা বিক্রেতারাও একটু সুযোগ পেলেই দামটা আরও একটু উসকে দিয়ে বাড়তি লাভ করেন।"
এই খামারি নেতা দাবি করেন, "এখন সরকারকে উৎপাদনকারী থেকে শুরু করে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিতে হবে। এর আগে ফিডের উৎপাদন খরচটাও সরকারকে খতিয়ে দেখতে হবে, এখন যে দাম তাতে কোন ম্যানিপুলেশন হচ্ছে কিনা।"
ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সেক্রেটারি নজরুল ইসলাম বলেন, "রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে যে হারে ফিডের উপকরণের দাম বাড়ছে তার সঙ্গে সমন্বয় করতে না পেরে অনেক কোম্পানিই এখন উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। খামারিরা উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ায় ফিড কোম্পানি লোকসান দিয়েও ব্যবসা করতে পারছে না।"
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২,৩৩৫ কোটি পিস ডিম উৎপাদন হয়েছে। তবে খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ে এদেশে প্রতিদিন ৪-৪.৫ কোটি পিস ডিম উৎপাদন হয়।