মানসিক পরিবর্তনে ধোঁয়াশা পেরিয়ে আলোর আঙিনায় রনি তালুকদার
স্বপ্নের দুয়ার খুলেছিল, কিন্তু তা কয়েক মুহূর্তের জন্য। এরপর দুয়ারে যে তালা লাগে, মরচে পড়ে যাওয়ার দশা। কিন্তু বছরের পর বছর চাবি চকচকে রাখতে চেষ্টার কমতি রাখেননি রনি তালুকদার। দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় দলের বাইরে থাকলেও পথ হারাননি, নিজেকে শাণিত করে গেছেন একটু একটু করে। টুর্নামেন্ট অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করেছেন, মানসিকতায় এনেছেন পরিবর্তন। দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফল মিলেছে, বিপিএলে রানের ফোয়ারা বইয়ে দিয়ে প্রায় আট বছর পর জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান।
সর্বশেষ বিপিএলে রংপুর রাইডার্সের হয়ে দারুণ সময় কাটে রনির। ইনিংস উদ্বোধনের দায়িত্ব সামলানো ৩২ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যান ১৩ ম্যাচে তিনটি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৩৬.৬৩ গড়ে ৪২৫ রান করেন, যা আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এই পারফরম্যান্স তাকে জায়গা করে দিয়েছে ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দলে। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দিয়ে জাতীয় দলে অভিষেক হয় তার, আর ওটাই শেষ ম্যাচ। সাত বছর আট মাস পর সেই ফরম্যাট দিয়েই ডাক মিললো তার।
আরও একবার স্বপ্নের দুয়ার খুললো, দীর্ঘদিন পর ডাক পেয়ে স্বভাবতই উচ্ছ্বাসের শেষ নেই রনির। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে অনুভূতি জানাতে গিয়ে অবশ্য বেশি কিছু বলতে পারলেন না তিনি। বললেন, 'খুবই ভালো লাগছে, অনেক ভালো লাগছে।' দীর্ঘদিন যে ডাকের অপেক্ষায় কেটেছে, সেই ডাকে রনি উচ্ছ্বসিত ঠিকই, কিন্তু এতোদিন ধরে বুনে আসা স্বপ্ন বাস্তবায়ন নিয়েই আপাতত ভাবনা তার।
বছরের পর বছর মনোযোগ ধরে রেখে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে আসা বাংলাদেশের এই ব্যাটসম্যান জানালেন, দীর্ঘ সময় ধরে সুযোগ না পেলেও আবারও জাতীয় দলের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখা এক মুহূর্তের জন্য বাদ দেননি তিনি। ফিরতে হবে, রনির কাছে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। দীর্ঘ এই সময়ে মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষেত্রেও জাতীয় দলে ফেরার তারণা তার জন্য রসদ হিসেবে কাজ করেছে। পাশাপাশি যে টুর্নামেন্টেই খেলেছেন, ব্যাট সেরা হতে চেয়েছেন। আর সেরা প্রস্তুতি সারতে সম্ভাব্য সব কিছুই করে গেছেন।
এতোটা সময়ে ধরে মনোযোগ ধরে রাখা, কতোটা সংগ্রামের ছিল, কারা পাশে ছিলেন; এসব জানাতে গিয়ে রনি বলেন, 'খেলোয়াড় হিসেবে যেখানেই খেলি না কেন, আপনাকে পারফর্ম করতে হবে। পারফরম্যান্সের বাইরে তো কিছু নেই, পাশাপাশি ফিট থাকতে হয়। তো সব মেনেই অনুশীলন করেছি, কখনও খারাপ হয়েছে, কখনও ভালো হয়েছে। খারাপ-ভালো মিলিয়েই জীবন এগিয়েছে। আমি ফরম্যাট বিবেচনা করে টুর্নামেন্ট অনুযায়ী অনুশীলন করেছি। ইমরান (সারওয়ার ইমরান) স্যারের সঙ্গে অনুশীলন করেছি।'
'অনেকেই সাহায্য করেছেন এই সময়টাতে। আগে আমি উড়িয়ে মারার চেষ্টা করতাম শুধু, এই প্রবণতা বেশি ছিল। আমি বিপিএলের আগে এবার এটা নিয়ে কাজ করেছি, মানসিকতা নিয়ে কাজ করেছি। মনোযোগ এবং লক্ষ্য যেন ঠিক থাকে, এটা নিয়ে কাজ করেছি। গ্রাউন্ড শট খেলার অনুশীলন করেছি, ইমরান স্যারের সঙ্গে কাজ করেছি। মাঝে মাঝেই আমি স্যারের কাছে গিয়েছি, অনুশীলন করেছি। আবার ব্যাটিংয়ের ভিডিও পাঠাতাম স্যারকে, উনি পরামর্শ দিতেন। উনার সঙ্গে বেশিই কাজ করা হয়েছে।' যোগ করেন রনি।
ফরম্যাট ও টুর্নামেন্ট অনুযায়ী প্রস্তুতি নিলেও জাতীয় দলে ফেরাটা ছিল রনির প্রধান লক্ষ্য। তার ভাষায়, 'জাতীয় দলে ফেরার লক্ষ্য তো অবশ্যই ছিল। পাশাপাশি টুর্নামেন্ট অনুযায়ী অনুশীলন করাটা ছিল আমার রুটিন। আমি অনুশীলন করতাম নিট কনসার্ন ক্রিকেট একাডেমিতে। এটা নারায়নগঞ্জের একটা একডেমি, নারায়নগঞ্জের লিগ খেলে, তাদের তিনটা দল। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগের দলেরও এতো কিছু নেই, যা নিট কনসার্ন ক্রিকেট একাডেমিতে আছে, দারুণ সুযোগ-সুবিধা এখানে। নিট কনসার্নের মালিক জাহাঙ্গীর মোল্লা ভাইকে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই। উনি আমাদের যে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে রেখেছেন, এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য। প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকতে এই একাডেমি আমাকে দারুণ সাহায্য করেছে।'
বাধার পথ পেরিয়ে ফের জাতীয় দলে রনি। লক্ষ্য অবশ্য আগের মতোই অভিন্ন, সুযোগ পেলে দিতে চান সেরাটা। সুযোগ না পেলেও একই প্রক্রিয়া মেনে খেলা চালিয়ে যেতে চান, 'আমি আমার মাইন্ড সেটআপ নিয়ে কাজ করেছি। তো সেভাবেই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেওয়া আছে যে, যেখানেই খেলবো, যেন নিজের সেরাটা খেলতে পারি। ভালো খেলা আমার প্রথম লক্ষ্য। জাতীয় দলে সুযোগ পেলে সর্বোচ্চটা দিয়ে আমার সেরাটা খেলার চেষ্টা করবো। আর সুযোগ না এলে জাতীয় দল বা যে লিগেই খেলি, পারফর্ম করতে চাই। এটাই আমার প্রধানতম কাজ।'
সারওয়ার ইমরানের সঙ্গে কাজ করে আসার ফলটাই বিপিএলে পেয়েছেন বলে মনে করেন রনি। পাশাপাশি দীর্ঘ সংগ্রামের পথে ব্যাটিং উন্নতিতে জাতীয় দলের ওপেনার লিটন কুমার দাসকে অনুসরণ করেছেন তিনি, 'ইমরান স্যারের কাজ করার ফলটাই পেয়েছি, গ্রাউন্ডে খেলার চেষ্টা করেছি। আমাদের লিটনের ব্যাটিং দেখেন, অনেক কিছু শেখা সম্ভব। লিটন কিন্তু জোরে মারে না, শুধু টাইমিং করে। এফোর্টলেস খেলে, ওর খেলা শুধু দেখতেই ইচ্ছা করে। অনেক গতির বলও কতো সুন্দর করে বাউন্ডারি মারে। আমি পাওয়ার প্লেতে খেলি, এখানে এতো জোরে মারার দরকার নেই। টাইমিং হলেই বল বেরিয়ে যায়। এসবই অনুশীলন করেছি, লিটনের ব্যাটিং অনুসরণ করেছি। ওর ব্যাটিং দেখলে টিভির সামনে থেকে উঠতে ইচ্ছা করে না।'