সংকটের সেবাদাতা: যেভাবে টিসিবি খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করছে
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ২৪ নং ওয়ার্ডের দোকান থেকে তার নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ভর্তুকি দামে কিনে বের হলেন ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশ (টিসিবি)-র কার্ডধারী মো. জসিমউদ্দীন ।
তাকে দেখে মনে হলো তিনি তার কেনা পণ্য নিয়ে সন্তুষ্ট। দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা গেলেও টিসিবি থেকে কেনার ফলে তার ওপর থেকে কিছুটা চাপ কমেছে।
নিজের টিসিবি কার্ড দেখিয়ে তিনি জানান, "আগে ট্রাকগুলো ঠিক সময়ে আসতো না। আমাদেরকে লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, তাড়াহুড়ো করে জিনিস কিনতে হতো। এমন অনেকবার হয়েছে, যখন আমি কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও কিছু কিনতে পারিনি। এখন আমি কার্ড দিয়ে বাড়ির পাশেই থাকা ডিলারের দোকান থেকে যেকোনো সময় প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারি। ডিলার কার্ড স্ক্যান করেই আমাকে পণ্য দেয়, যে কারণে এখানে সিস্টেমকে ফাঁকি দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।"
'জনগণের সরকার' হিসেবে প্রচলিত শব্দকে অত্যুক্তি মনে হলেও টিসিবির মাধ্যমেই হয়তো এই শব্দবন্ধের সবচেয়ে সফল প্রয়োগ দেখা যায়।
কম আয় করা মানুষদের জীবনে স্বস্তি এনে দেওয়ার জন্য টিসিবি অভিবাদন পেলেও তারা থেমে থাকেনি। জনসাধারণের অভিযোগের কথা আমলে নিয়ে টিসিবি তাদের সিস্টেম ঢেলে সাজিয়ে একে সুরক্ষিত করেছে, সাথে তাদের সেবার ক্ষেত্রও বাড়িয়েছে।
টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান জানান, প্রয়োজন অনুযায়ী সেবার ক্ষেত্র বাড়ানো হয়েছে।
তিনি জানান, "এটা অর্জনের জন্য টিসিবিকে সেলস ম্যানেজমেন্টে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। ট্রাক থেকে বিক্রির বদলে ঢাকাসহ সারাদেশজুড়ে বিভিন্ন জায়গার নির্দিষ্ট পয়েন্টে সেলস পয়েন্ট স্থাপন করা হয়েছে। এই কেন্দ্রগুলোতে সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ পাওয়া যায়, আর সুবিধাভোগীরা যেকোনো সময়ে সেগুলো কিনতে পারেন।"
সুবিধাভোগীদের সংখ্যা জানা থাকলে পরিকল্পনা করা ও তা প্রয়োগ করা আরও সহজ উল্লেখ করে তিনি জানান, "আমরা স্থানীয় সরকার এবং জনপ্রতিনিধিদের সাহায্য পেয়েছি, যারা আমাদের কার্যক্রমও দেখাশোনা করেন। তারা রেশন কার্ডের তালিকায় কাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে তা জানিয়ে সহযোগিতা করেছেন। আমাদের কতটুকু কার্যক্রম বাড়ানো দরকার তা নির্ধারণ করতে সাহায্য করেছে এটি।"
সেলস সেন্টারগুলো স্থাপন করার পর জনসাধারণকে আর ট্রাকের জন্য লাইন ধরে অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। বৃদ্ধ কিংবা স্বাস্থ্যসমস্যায় ভোগা ব্যক্তিদের জন্য অনেক সুবিধা বয়ে এনেছে এই উদ্যোগ।
৩২ নং ওয়ার্ডের একজন কার্ডধারী রেনু আরা জানান, "আমার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন ধরে দাঁড়ানো বেশ কষ্টকর ছিল। এখন এখানে একটা দোকান হয়েছে। সুবিধামতো সময়ে আমি যেতে পারি। মাঝেমধ্যে ট্রাকগুলো এমন সময়ে আসতো যখন আমার হাতে টাকা থাকতো না, তখন আমি কিনতে পারতাম না। এখন এই সমস্যা আর নেই।"
ট্রাকে পণ্য লোড করা ও আনলোড করতে প্রচুর সময় অপচয় হতো, যে কারণে ট্রাকও আসতো দেরি করে। তাছাড়া অনেক ভোক্তাই নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন কারণে আসতে পারতেন না। তবে এখন টিসিবির স্থায়ী দোকান তৈরি হওয়ার ফলে এই সমস্যাগুলোর সমাধান হয়েছে। জনসাধারণ এখন নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী যেকোনো সময়ে নিজেদের প্রয়োজন অনুয়ায়ী পণ্য কিনতে পারেন, আরও সুশৃঙ্খলভাবে।
টিসিবি ২০২২ সাল থেকে তাদের কেন্দ্রগুলো থেকে বাজারের দামের তুলনায় কম দামে কার্ডধারী সুবিধাভোগীদের কাছে পণ্য বিক্রি করে আসছে। এর আগে সাধারণত রমজান মাসেই তারা কার্যক্রম পরিচালনা করতো, যখন ব্যবসায়ীরা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিত।
কোভিড মহামারি চলাকালীন বছরে চারবার তাদের কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে টিসিবি। এরপর সরকারের উদ্যোগে সারাবছর জুড়ে টিসিবির কার্যক্রম চালানো শুরু হয়।
একেবারেই কম আয় করা মানুষদের গায়ে যেন মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা না লাগে সেজন্য টিসিবি ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করে। সারা দেশজুড়ে ভর্তুকি দামে খাবার সরবরাহ ও বিক্রি করে বাজার ঠিক রাখে তারা।
কোভিড চলাকালীন সময়ে কার্যক্রম পরিচালনার পর টিসিবি আলোচনায় উঠে আসে। চাকরি হারানো কিংবা আয় কমে যাওয়া অনেকের জীবন সহজ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কর্পোরেশনটি। টিসিবির কার্যক্রম এখনো গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায়।
ঢাকার খাদ্য বিভাগের ওপেন মার্কেট সেলস (ওএমএস)-এর চাল বিতরণ করা ট্রাকের পেছনের লম্বা লাইনই প্রমাণ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ভয়াবহ অবস্থা।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর এক গবেষণায় পাওয়া যায় যে, ঢাকা মেট্রোপলিটন শহরে জীবনযাত্রা পরিচালনার ব্যয় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের তুলনায় ১১% বৃদ্ধি পেয়েছে।
মুদ্রাস্ফীতির এই ঊর্ধ্বগতির চাপে জনগণের দুর্ভোগ কমাতে টিসিবির কার্যক্রম আরও বাড়ানো হয়েছে বলে জানান এর সাথে জড়িত থাকা কর্মকর্তারা।
প্রতিবারের দুর্যোগের পর টিসিবির কার্যক্রম আরও মজবুত ও সংগঠিত হয়। তবে জরুরি সময়ে টিসিবির এই ভূমিকা নতুন কিছু নয়। সংকটের সময় থেকেই জন্ম হয়েছিল এই প্রতিষ্ঠানের।
সংকট থেকে জন্ম যে প্রতিষ্ঠানের
মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যা ছিল, তা নিয়েই নতুন করে লড়াই শুরু করতে হয়েছিল। দেশের রাস্তা-ঘাট, সমুদ্রবন্দর যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠেছিল।
সে সময় প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যেন অস্বাভাবিক হারে না বাড়ে, সে কারণেই ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় টিসিবি। তৎকালীন সময়ে টিসিবির মূল কাজ ছিল শিল্প কাঁচামাল আমদানি করা এবং তৈরি পোশাক ও পাট রপ্তানি করা।
সময়ের সাথে সাথে অর্থনীতি স্বাভাবিক হয়ে ওঠে এবং সব ধরনের বাণিজ্যে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়। এবার টিসিবির ভূমিকাও কিছুটা বদলে যায়। তাদের নতুন কাজ হয় সংকটের সময় দ্রব্যমূল্যের দাম জনসাধারণের হাতের নাগালে রাখা।
এরপর থেকে প্রতি রমজান মাসে টিসিবি খুবই কম দামে পণ্য বিক্রি শুরু করে। করোনা মহামারির পর টিসিবি আরও নিয়মিত হারে পণ্য সরবরাহ করার দিকে নজর দেয়। তবে বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকট প্রকটাকার ধারণ করায় টিসিবি আবারো এগিয়ে এসেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে বছরে ২০ লক্ষ টন ভোজ্যতেল এবং চিনির চাহিদা রয়েছে। এগুলো ছাড়াও ডালের চাহিদা ছয় লক্ষ টন।
টিসিবির লক্ষ্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২.৪ লক্ষ টন ভোজ্যতেল অর্থাৎ, চাহিদার ১২% সরবরাহ করা। এর পাশাপাশি ১.২ লক্ষ টন চিনি এবং ২.৪ লক্ষ টন ডান বিক্রির লক্ষ্যও রয়েছে তাদের।
এছাড়া রমজানকে সামনে রেখে ১ হাজার টন ছোলা এবং ১,৩০০ টন খেজুর বিক্রিও করবে তারা।
যেভাবে টিসিবি কাজ করে
টিসিবি স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক দুই বাজার থেকেই তাদের পণ্য কেনে, বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরেই তারা স্থানীয় বাজার থেকে সয়াবিন তেল কিনে আসছে।
কিছুদিন আগে এক মন্ত্রিপরিষদ কমিটি ১.১ কোটি টন সয়াবিন তেল এবং ৪ হাজার টন ডাল কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করে। তেল কেনা হবে মেঘনা গ্রুপের কাছ থেকে, আর ডাল কেনা হবে তুরস্কের একটি কোম্পানি থেকে। সয়াবিন তেল কেনা হবে ১৭৬.৮৮ টাকা প্রতি লিটারে এবং ডাল কেনা হবে ৯১.৬০ টাকা প্রতি কেজিতে। টিসিবি এরপর তেল বিক্রি করবে ১১০ টাকা প্রতি লিটারে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ভর্তুকির মাধ্যমে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া হবে।
যেহেতু টিসিবি রমজান ছাড়াও বছরের অন্যান্য সময়েও পণ্য বিক্রি করছে, সে অনুযায়ী ভর্তুকির পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে টিসিবির ঘাটতি ছিল ৫০০ কোটি টাকা, যেটি এখন বেড়ে এক হাজার কোটি টাকার ওপরে দাঁড়িয়েছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১,১৫৮ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য বাজেটে টিসিবির এই ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ১,২৬২ কোটি টাকা।
টিসিবির উপাত্ত অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৪,৭২৮ জন ডিলার রয়েছে, যেখানে ২০০৯ সালে ছিল মাত্র ১৮৭ জন। ডিলাররা প্রতি পণ্যের জন্য ৫ টাকা কমিশন পান, যার মাধ্যমে পণ্য ওঠানো-নামানো এবং পরিবহনের খরচ উঠে আসে।
জরুরি অবস্থায় সরবরাহের জন্য পণ্য স্টকে রাখতে টিসিবি চট্টগ্রাম, সিলেট ও রংপুরে ২৮ কোটি টাকার বিনিময়ে ৩টি আধুনিক ওয়্যারহাউজ নির্মাণ করছে।
বর্তমানে জরুরি অবস্থায় টিসিবির অস্থায়ী ও ভাড়া নেওয়া ওয়্যারহাউজগুলোতে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টন পণ্য মজুদ রাখার সক্ষমতা আছে। এগুলো ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে তারা ১২টি আঞ্চলিক অফিস/অফিসক্যাম্প তৈরি করেছে, যেগুলোর মাধ্যমে সারাদেশে সরবরাহ চলমান রাখা হয়।
রয়ে যাওয়া চ্যালেঞ্জ
টিসিবির মূল চ্যালেঞ্জ কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত মূলধন। প্রতিষ্ঠানটি ক্রমাগত তাদের জরুরি মূলধন হিসেবে ১,০০০ কোটি টাকা চাইলেও তা এখনো অনুমোদন করা হয়নি। এর ফলে কোম্পানিটিকে ৯% সুদ হারে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার টিসিবির ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের গ্যারান্টর হিসেবে কাজ করার ফলে কিছুটা সুবিধা পেলেও সরবরাহকারীরা তাদের পণ্য নেওয়ার সময় ২% হারে আয়কর প্রদান করতে হচ্ছে, যেটি পণ্যের দামে যুক্ত করার ফলে পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে।
তাছাড়া টিসিবির সুবিধাভোগী কার্ড ডিজিটাল না হওয়া আরেকটি চিন্তার বিষয়। টিসিবি চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান বিশ্বাস করেন কার্ড ডিজিটাইজ করা হলে পুরো ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আরও বাড়বে।