অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণ: মনিটরিংয়ে ছিল না দক্ষ লোক
মনিটরিংয়ে দক্ষ লোক না থাকায় সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন শিল্প পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের তদন্ত কর্মকর্তারা।
তারা বলেন, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, প্রশিক্ষিত লোক ছাঁটাই করে দুই ডিপ্লোমা সনদধারীকে দিয়ে কারাখানা চালানোর ফলে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে চীনের তৈরি নতুন প্ল্যান্টটি স্থাপন করা হয় ২০১৬ সালে। সে সময় মেশিন সরবরাহ করা প্রতিষ্ঠানের চীনা প্রকৌশলীরা সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের অন্তত পাঁচজন প্রকৌশলীকে প্রশিক্ষণ দেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ সেই প্রকৌশলীদের ছাঁটাই করে ডিপ্লোমা সনদধারী দুই কর্মকর্তাকে দিয়ে কারখানা পরিচালনা শুরু করে।
শিল্প পুলিশ-৩ এর পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ সুলাইমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের পরিচালক পারভেজ সাহেব জানিয়েছেন, চীনা কোম্পানির হাতে প্রশিক্ষিত কর্মকর্তাদের তারা ধরে রাখতে পারেননি। অনেককে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে; অথচ তারা ছিলেন অক্সিজেন প্ল্যান্টের বিষয়ে প্রশিক্ষিত। মূলত বিস্ফোরিত অক্সিজেন প্ল্যান্টটিতে অদক্ষ জনশক্তি দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছিল। এ কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।"
মঙ্গলবার (১৪ মার্চ) চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড় থেকে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের পরিচালক পারভেজ উদ্দিন সান্টুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এদিকে, সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের বিস্ফোরণে কর্তৃপক্ষের অনিয়ম পেয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটিও। মঙ্গলবার চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত কমিটির প্রধান, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসান।
প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে রাকিব হাসান বলেন, "অক্সিজেন প্ল্যান্টে দুর্ঘটনা বিরল। সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের দুর্ঘটনাটি বাংলাদেশে প্রথম অক্সিজেন প্ল্যান্ট দুর্ঘটনা। শুধু তাই নয়, গত এক দশকে সারা পৃথিবীতে এমন নজির চার থেকে পাঁচটির বেশি নেই। সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষের কিছু অবহেলা এবং কিছু ঘাটতি ছিল।"
প্ল্যান্টের এয়ার সেপারেশন কলামে সেফটি ভালভটি অকেজো থাকার বিষয়টি বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। ভালভ অকেজো থাকায় দাহ্য হাইড্রোকার্বনের মতো গ্যাস এয়ার সেপারেশন কলামে জমা হতে থাকে; একপর্যায়ে এই চাপ স্বাভাবিকের চেয়ে ৭ থেকে ৮ গুণ বেশি হয়ে যায়। পরে কোনো একটি স্পার্ক বা স্ফুলিঙ্গের স্পর্শ থেকে বিস্ফোরণটি ঘটে। কারখানায় দক্ষ জনবল না থাকায় বিষয়টি আগে টের পায়নি কর্তৃপক্ষ।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলেন, সাধারণত অক্সিজেন প্ল্যান্টের কলামে চাপ ৪ থেকে ৮ বিএআর পর্যন্ত সহনীয়। কিন্তু সীমা প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের সময় তা ৭ থেকে ৮ গুণ বেড়ে অন্তত ৬০ বিএআর পর্যন্ত হয়। এজন্য অনেক দূর পর্যন্ত কলামের টুকরো ছড়িয়ে পড়ে। বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি এয়ার সেপারেশন কলামটি। এ কারণে বিস্ফোরণের পর কলামটির বড় বড় টুকরো আধা কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত গিয়ে পড়েছে।
শিল্প পুলিশ-৩ এর সহকারী পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন বলেন, "সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টটি শুধু দুইজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে চালানো হচ্ছিল। এছাড়া কারখানার সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন মানবিক থেকে পাস করা একজন। নানান সীমাবদ্ধতায় পূর্বের ঘটনাগুলোতে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ায় শিল্প মালিকরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু এবার আর ছাড় দেওয়া হবে না।"
জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান কথা বলেন, "সীমা অক্সিজেন অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল না। এ দুর্ঘটনার পর আমরা ভারি ও মাঝারি শিল্পের জন্য মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেছি। চট্টগ্রামে যে অক্সিজেন প্ল্যান্ট আছে সেগুলোর জন্য একটি ম্যানুয়েল তৈরি করা হবে। ঝুঁকিপূর্ণ যেসব কারখানা আছে সেগুলোতে ২-৩ দিনের মধ্যে পরিদর্শন শুরু হবে।"
গত ৪ মার্চ বিকেলে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ৭জন নিহত হন, গুরুতর আহত হন আরও ৩২ জন।