ইউক্রেন বাখমুতেই গোলাবারুদ নিঃশেষ করে ফেলছে, ভবিষ্যতের লড়াই ঝুঁকিতে
বাখমুতের অধিকার ধরে রাখতে ইউক্রেনীয় বাহিনী প্রতিদিন কয়েক হাজার আর্টিলারি গোলা নিক্ষেপ করছে রাশিয়ান বাহিনীর ওপর। মার্কিন ও ইউরোপীয় কর্মকর্তারা গোলার ব্যবহারের এ মাত্রাকে অস্থিতিশীল হিসেবে উল্লেখ করে এত সংখ্যক গোলাবারুদের ব্যবহার সামনের বসন্তকালীন যুদ্ধকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন। খবর দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর।
ইউক্রেন এত বেশি গোলাবর্ষণ করছে যে এ নিয়ে খোদ পেন্টাগন কিয়েভের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইউক্রেন চায় যেকোনোভাবে বাখমুতকে রাশিয়ার দখল থেকে রক্ষা করতে। আবার একই সঙ্গে বসন্তে নিজেদের হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করার পরিকল্পনাও করছে এটি। তাই এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোলাবারুদ অপচয় না করার জন্য মার্কিন কর্তৃপক্ষ ইউক্রেনকে পরামর্শ দিয়েছে।
এদিকে ইউক্রেনের ভবিষ্যতের পাল্টা যুদ্ধের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন কয়েক হাজার ন্যাটো ও সোভিয়েত ধরনের আর্টিলারি গোলা ও রকেট পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কিন্তু একজন জ্যেষ্ঠ মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ গোলাবারুদ পাঠানোর প্রস্তুতি একটি 'চূড়ান্ত চেষ্টা' হিসেবে বিবেচনায় রাখা হয়েছে। কারণ ইউক্রেনের গোলা ব্যবহারের গতির সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য এর মিত্র দেশগুলোর কাছেও পর্যাপ্ত সংখ্যক গোলাবারুদ নেই। পশ্চিমা কারখানাগুলোতে গোলাবারুদ উৎপাদন বাড়ানো হলেও চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত সরবরাহ করতে আরও কয়েক মাস লেগে যাবে।
আর এসবের ফলে কিয়েভ এখন ক্রমশ একটি বিপৎসংকুল পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ানদের তাড়ানোর আসন্ন সুযোগের সময় ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে হয়তো গোলাবারুদের সংকটের সঙ্গেও যুঝতে হবে।
এছাড়া ইউক্রেনের সৈন্যক্ষয়ের সংখ্যা এতই বেড়েছে যে, সেনা অফিসারদেরকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কোনো ইউনিটকে বাখমুত রক্ষা করতে পাঠাবেন নাকি বসন্ত অভিযানে কাজে লাগাবেন। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর কাছে পরিচয় গোপন রাখার শর্তে খোদ ইউক্রেনীয় সেনা কর্মকর্তারাই এ উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।
ইউক্রেন যুদ্ধের অন্যতম প্রভাবশালী অস্ত্র হয়ে উঠেছে আর্টিলারি। এসব আর্টিলারি অস্ত্রের মধ্যে হাউটজার ও মর্টারও রয়েছে। দুই দেশেরই শক্তিশালী বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে। ফলে লড়াই যা হচ্ছে তার বেশিরভাগই ঘটছে ভূমিতে।
এক বছর পার হয়ে যাওয়া এ যুদ্ধের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ রাশিয়ান সৈন্য মারা গেছে বলে ধারণা করা হয়। অন্যদিকে ইউক্রেনের ক্ষেত্রে এ আনুমানিক সংখ্যা এক লাখের চেয়ে কিছু বেশি। রাশিয়ার জনসংখ্যা ইউক্রেনের চেয়ে বেশি, এটি চাইলেই সাধারণ জনগণকে সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্ত করতে পারে। কিন্তু দুই পক্ষই গোলাবারুদের সংকটে ভুগছে। ইউক্রেনের চেয়েও বেশি সংখ্যক গোলা নিক্ষেপ করছে রাশিয়ানরা।
বাখমুতে যুদ্ধ করা এক ইউক্রেনীয় সৈনিক সম্প্রতি বলেছেন, 'আমাদের মর্টারের জন্য গোলা দরকার।' তিনি জানান, তার ব্যাটালিয়নকে পুনরায় গোলাবারুদ সরবরাহ করা হয়নি। ইউক্রেনের টি-৮০ ট্যাংকের একজন কমান্ডারও জানিয়েছেন, তার ট্যাংকের গোলাও প্রায় শেষের পথে।
বাখমুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা একটি ব্রিগেডের আরেকজন কমান্ডার গত মঙ্গলবার ফেসবুকে এক পোস্টে জানিয়েছেন, তার বিগ্রেড 'মারাত্মক গোলাবারুদের সংকটে ভুগছে'। তিনি একটি ঘটনার কথাও জানিয়েছেন। একবার তার ইউনিট একটি রাশিয়ান টি-৯০ ট্যাংককে অচল করে দেয়। কিন্তু ওই ট্যাংককে পুরোপুরি বিধ্বস্ত করার জন্য তার ইউনিটকে গোলা নিক্ষেপ করতে অনুমতি দেওয়া হয়নি, কারণ গোলাবারুদের 'মূল্য অনেক বেশি'।
পেন্টাগনের অনুমান, ৬০০ মাইল দীর্ঘ সম্মুখসারিতে ইউক্রেনীয় বাহিনী প্রতিদিন কয়েক হাজার গোলা নিক্ষেপ করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতি মাসে ৯০ হাজার আর্টিলারি গোলা উৎপাদনের প্রত্যাশা করছে। কিন্তু এ পরিমাণ গোলা উৎপাদন পর্যায়ে পৌঁছাতে দেশটির আরও দুই বছর সময় লাগতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষেত্রেও গোলাবারুদের উৎপাদন বাড়াতে সময় লাগবে। এদিকে একটি গোপন ব্রিটিশ টাস্কফোর্স সারাবিশ্ব থেকে সোভিয়েত নকশার গোলাবারুদ সংগ্রহ ও ক্রয় করার চেষ্টা করছে।
ইউক্রেনের কাছে পশ্চিমাদের সরবরাকৃত প্রায় ৩৫০টি হাউটজার রয়েছে। এছাড়া সোভিয়েতযুগের আর্টিলারি অস্ত্রের সংখ্যাও কম নয় দেশটির সংগ্রহে।
বুধবার এক সাক্ষাৎকারে লিথুয়ানিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ইউক্রেনের গোলাবারুদ সমস্যার সবচেয়ে উত্তম সমাধান হবে যদি ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো তাদের উৎপাদন বাড়াতে পারে।
কিন্তু এ কাজটা সহজ নয়। এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রসর সামরিকশক্তির দেশগুলোর জন্যও এভাবে দ্রুতগতিতে গোলাবারুদ উৎপাদন করা একটি কঠিন কাজ। ইউক্রেন যুদ্ধ ঘটতে যাচ্ছে এবং এ যুদ্ধে প্রচুর সংখ্যক আর্টিলারি গোলা সরবরাহ করতে হবে — আগে থেকেই এমন চিন্তা করে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা গোলাবারুদের ভান্ডার বৃদ্ধি করে রাখেনি।
তবে আপাতত বাইডেন প্রশাসন মনে করছে না বাখমুতে গোলাবারুদের খরচ ইউক্রেনের বসন্তকালীন অভিযানের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু বাখমুতের যুদ্ধ আরও বেশিদিন চললে এমন কিছু ঘটার সম্ভাবনাও বাড়বে।