উপকূলীয় হাসপাতালগুলোতে সুপেয় পানির দায়িত্ব কার?
ডিপ টিউবওয়েলের পানি মোটরের মাধ্যমে তুলে রোগীদের খাবার পানিসহ হাসপাতালের সব ধরণের পানির চাহিদা পূরণ করে সাভারের ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। হাসপাতালের বার্ষিক বাজেট থেকে বিদ্যুতের বিল দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মতো মোটর দিয়ে পানি তোলা যায় না খুলনার পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে; ভূগর্ভস্থ পানির সংকট, লবণাক্ততার কারণে সেখানে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। কিন্তু সেখানে হাসপাতালের রোগীর খাবার বা ব্যবহার্য পানির জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা বা বরাদ্দ নেই।
এমনকি পৌরসভা থেকে পানি কিনলে বা যেসব হাসপাতালে রিভার্স অসমোসিস (আরও) মেশিন আছে সেসব মেশিন নষ্ট হলে তা ঠিক করার টাকাও দেয় না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
দেশের সব হাসপাতালের জন্যই ধামরাই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মতো ব্যবস্থা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু উপকূলীয় এলাকার হাসপাতালগুলোর জন্য সুপেয় পানির আলাদা ব্যবস্থা না থাকায় পানির তীব্র সংকটে থাকে রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। এনজিও বা অন্য কোন মাধ্যমে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হয় হাসপাতালগুলোকে।
পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মত মোংলা, শরণখোলা, দাকোপসহ উপকূলীয় এলাকার প্রায় ১৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোর অধীনে থাকা সাব সেন্টারে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। স্থানীয় পৌরসভা বা এনজিওর মাধ্যমে পানির ব্যবস্থা করে রোগীদের পানির চাহিদা পূরণ করে এসব হাসপাতাল। সেজন্য রোগীর কাছ থেকে পানির খরচ নিতে হয় তাদের। কোন কোন হাসপাতালে রোগীরা বাইরে থেকে পানি কেনে।
উপজেলার ১০ ইউনিয়নের মানুষের জন্য পাইকগাছা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স অন্যতম প্রধান স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। প্রতিদিন বাইরে থেকে দেড় শতাধিক রোগী কম খরচে চিকিৎসা সেবা পেতে এখানে যান। খাবার পানির ব্যবস্থা না থাকায় রোগীদের বাইরে থেকে পানীয় জল কিনতে হয়, যা তাদের চিকিৎসার খরচ বাড়িয়ে দেয়।
এদিকে উপকূলীয় এলাকায় পৌরসভা ও ব্যক্তিগতভাবে অনেকে পানির প্ল্যান্ট বসিয়ে পানি বিক্রি করে।
সূত্রমতে, ২০১৪ সালের দিকে পাইকগাছা পৌরসভা থেকে হাসপাতালের জন্য সুপেয় পানি কিনতো পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কয়েক মাস পানি কেনার পর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বিলের টাকার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি লিখলে অধিদপ্তর জানায় পানির জন্য আলাদা কোন বরাদ্দ নেই। পানির ব্যবস্থাপনা হাসপাতালের সম্পূর্ণ নিজস্ব। তখন হাসপাতাল পানির লাইনটা বাতিল করে দেয়।
২০১৯ সালে ওয়াটারএইড বাংলাদেশের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তায় স্থানীয় এনজিও নবলোক, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভিতরে খাবার পানির ভেন্ডিং মেশিন সহ একটি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম স্থাপন করে।
পাইকগাছার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নীতিশ চন্দ্র গোলদার টিবিএসকে বলেন, "এখানে সুপেয় পানির অনেক সংকট। ডিপ টিউবওয়েলের পানি ওঠে না। শ্যালো টিউবওয়েলের পানিতে প্রচুর আয়রন। পুকুরের পানি পাম্পের মাধ্যমে হাসপাতালে ব্যবহার করা হয়। আর ওয়াটার ভেন্ডিং মেশিন থেকে দেয় ২ টাকার মুজিব কয়েন ও ৫ টাকার মুজিব কয়েন দিয়ে পানি নেয় রোগী ও স্বজনেরা। প্রতি কেজি পানি ১ টাকা করে। এ টাকা আমাদের একটি অ্যাকাউন্ট আছে সেটাতে যায়। মেইনটেইনেন্স খরচ বাদে মাসে দুই হাজার টাকার মতো জমা হয় সে অ্যাকাউন্টে।"
''সরকারি হাসপাতালে রোগীদের কাছ থেকে পানির জন্য টাকা নিতে আমাদের খারাপ লাগে কিন্তু উপায় তো নেই। পানির জন্য অধিদপ্তর থেকে আমাদের জন্য কোন বরাদ্দ নেই'', বলেন ডা. নীতিশ চন্দ্র গোলদার।
চৈত্র-বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ্য মাসে মোংলার অন্যান্য এলাকার মতো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও পানির সংকট হয়। পুকুরের পানি পাম্পের মাধ্যমে হাসপাতালের কাজে ব্যবহার করা হয় ও পৌরসভা থেকে কেনা পানি রোগীরা পান করে।
মোংলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শাহীন বলেন, পৌরসভাকে হাসপাতালের বাজেট থেকে বছরে একটা সার্ভিস চার্জ দেয়া হয় সেখানে পানির বিলটা থাকে। হাসপাতালের জন্য আলাদা কোনো প্ল্যান্ট নেই। উপকূলের হাসপাতালের পানির জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আলাদা প্ল্যান্ট থাকলে ভালো হয়।
বিশুদ্ধ পানির সংকটের কারণে পানিবাহিত রোগ উপকূলীয় এলাকায় বেশি হয়। লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় এলাকায় হাইপারটেনশন, প্রি-এক্লাম্পসিয়া, এক্লাম্পসিয়া ও চর্মরোগ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রোগী, ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীরা বাইরে থেকে এক টাকা লিটারে পানি কিনে খায়। হাসপাতালে জনপ্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে পাঠানো ফিল্টার মেশিন বসানো হয়েছিলো যা দীর্ঘদিন ধরে সচল নেই। এছাড়া ওয়াটার এইড ও রূপান্তরের কোলাবোরেশনে রিভার্স অসমোসিস (আরও) মেশিন বসানো হয়েছিলো কিন্তু লবণাক্ততার কারণে সেই মেশিন প্রায়ই নষ্ট থাকে।
দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক নিজামী টিবিএসকে বলেন, "লবণাক্ততার কারণে আরও মেশিনের মেমব্রেন প্রায়ই নষ্ট হয়। কয়েকবার বদলেছি। অধিদপ্তরে লেখালেখি করেও মেশিন ঠিক করার জন্য অর্থ পাওয়া যায় না। তাই বাইরে কমার্শিয়াল বেসিসে আরও মেশিন থেকে পানি কিনে খায় রোগীরা।"
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, "সব হাসপাতালে পানির ব্যবস্থা করার দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। সারাদেশে যে ব্যবস্থা উপকূলীয় এলাকা বা পাহাড়ি এলাকাও তাই থাকবে তেমন তো না। যেখানে পানির সংকট সেখানে সেইখানকার উপযোগী ব্যবস্থা করতে হবে। পৌরসভা থেকে কেন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পানি কিনবে? আর এনজিও যদি পানির ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর তো তারা চলে যাবে।"
''দিন দিন উপকূলে পানির সংকট তীব্র হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন করে উপকূলীয় হাসপাতালগুলোর জন্য পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে এনজিও এখন যেভাবে পানির ব্যবস্থা করে দিচ্ছে সেটাই সরকারিভাবে করতে পারে,'' বলেন ডা. আবু জামিল ফয়সাল।