দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপে শ্রমজীবীরা
এক বছর আগেও দুপুরে ইচ্ছে হলেই মাছ দিয়ে ভাত খেতে পারতেন রিকশাচালক আবদুল জব্বার। সপ্তাহে অন্তত দু'দিন ফার্মের মুরগি বা মাছ খেতেন। বাকি পাঁচদিন ডিম বা সবজি দিয়ে চললেও হতো। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব হচ্ছে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস। মন না চাইলেও প্রতিদিনই ডিম বা সবজি ও ডাল দিয়ে দুপুরের খাবার চালিয়ে নিতে হচ্ছে।
আবদুল জব্বার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এখন হোটেলে একটা মাছের দাম নূন্যতম ৭০ টাকা। মাছ দিয়ে ভাত খেতে ১১০ টাকা খরচ হয় এক বেলায়। আমার পরিবার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে থাকে। এ কারণে দু'বেলাই হোটেলে খেতে হয়। সবজি বা ডিম দিয়ে ভাত খেতেও ৬০ টাকা খরচ। পরিবারেও টাকা পাঠাতে হয়। এখন খুব কঠিন সময় যাচ্ছে।"
চট্টগ্রাম নগরীর কাজির দেউরি মোড়ে আবদুল জব্বারের সঙ্গে টিবিএস প্রতিবেদক কথা বলার সময় যোগ দেন পাশে থাকা আরো দু'জন রিকশাচালক ময়মনসিংহের মো. আনোয়ার হোসেন ও চাঁদপুরের মোহাম্মদ সুমন। তাদের ভাষ্য—শুধু দুপুরের খাবারে নয়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সারাদিনের নাস্তার ব্যয় বেড়ে অন্তত দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কারণ রিকশা চালানোর মতো পরিশ্রমের কাজ করলে বারবার নাস্তা করতে হয়। অর্থাৎ প্রতি দুই ট্রিপ অন্তর একবার করে চা-নাস্তা করেন তারা। এজন্য নাস্তা বা খাবারের দামবৃদ্ধির প্রভাব তাদের ওপর সবচেয়ে বেশি পড়েছে।
রিকশাচালক আনোয়ার ও সুমন সারাদিনের আয়-ব্যয়ের হিসেব দিয়ে টিবিএসকে বলেন, প্রতিদিন ৫০০-৬০০ টাকা আয় হয়। এরমধ্যে রিকশার কোম্পানিকে ভাড়া দিতে হয় ১০০ টাকা। আর প্রতিদিন পান-ধূমপান, খাবারের নাস্তার পেছনে ২০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়। দুই বছর আগেও তা ১০০-১৫০ টাকায় হয়ে যেত। সবকিছুর দাম বাড়ায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। অপরদিকে অর্থনৈতিক খারাপ অবস্থার কারণে সাধারণ মানুষও রিকশায় চড়া কমিয়ে দিয়েছেন। তাদের কাছ থেকেও বেশি ভাড়া চাওয়া যায় না।
শহরের রাস্তার পাশের অস্থায়ী দোকানগুলোতে নাস্তা করেন রিকশা চালকসহ শ্রমজীবীরা। প্রতি দুই ট্রিপের পর সড়কের মোড়ে দাঁড়িয়ে চা, বন (ব্রেড), কেক, বিস্কুট, সিঙ্গারা, সমুচা দিয়ে নাস্তা করেন। আর সকালে রুটি, পরটা, ডাল বা ভাত দিয়ে নাস্তা সারেন তারা।গত তিন বছরে ধাপে ধাপে বেড়েছে এসব পণ্যের দাম। মূলত এসব পণ্য তৈরির কাঁচামালের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে। করোনা মহামারির প্রভাব, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সংকট, জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধি, সর্বশেষ ডলার সংকটের কারণে প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে কম-বেশি।
সড়কের পাশের অস্থায়ী নাস্তার দোকানগুলোর তথ্যমতে, তিন বছর আগের হিসেবে এক কাপ চায়ের দাম ৬-৮ টাকা ছিল। বর্তমানে তা ১০-১২ টাকা। ৫ টাকার কমে খোলা বিস্কুট পাওয়া যায় না। বন জাতীয় বিভিন্ন নাস্তা ৫ টাকা থেকে বেড়ে ৮-১০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সিঙ্গারা-সমুচা ৫ টাকা থেকে ১০ টাকায় বেড়েছে। রুটি-পরোটা ৬ টাকা থেকে বেড়ে ১০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। রান্না করা সবজি-ভাজি প্রতি বাটি ও ডিম ১০ টাকা বেড়ে ২৫ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। মাছ-মুরগী প্রতি বাটি ৪০ টাকা থেকে ৭০-৮০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। নাস্তা ও খাবার ৬০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্তও বেড়েছে।
রিকশাচালক আনোয়ার বলেন, চট্টগ্রামের বেশিরভাগ এলাকা একসময় পাহাড়ি ছিল। এ কারণে সড়কগুলো উঁচু-নিচু। তাই রিকশা চালাতে পরিশ্রম বেশি হয়।
নগরীর খুলশী এলাকার একটি বস্তির বাসিন্দা মোহাম্মদ তাসকীন টিবিএসকে বলেন, ভ্যানগাড়িতে করে রাস্তায় বসে সবজি বিক্রি করি। দৈনিক ৪০০-৫০০ টাকা আয় হয়। কিন্তু নিজের খাবারে খরচ হয়ে যায় ১০০-১৫০ টাকা।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, গত তিন বছরে প্রতি কৌটা কনডেন্সড মিল্কের দাম ২৫ টাকা থেকে বেড়ে ৯৫ টাকায় ঠেকেছে, প্রতি কেজি চিনি ৬২ টাকা থেকে ১১০ টাকায়, গুঁড়া দুধ কেজিপ্রতি ৫২০ টাকা থেকে ৮৩০ টাকায় পৌঁছেছে।
বন (ব্রেড) ও নাস্তা তৈরির প্রধান উপকরণ খোলা ময়দা কেজিপ্রতি ৩০ টাকা থেকে ৬২ টাকা, আটা ২৬ টাকা থেকে ৫৮ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিন প্রতি লিটার ৭৮ টাকা থেকে বেড়ে ১৬৮ টাকায় ও প্রতি লিটার পাম অয়েল ৬০ টাকা থেকে বেড়ে ১২৫ টাকায় পৌঁছেছে তিন বছরে।
চট্টগ্রাম ভিত্তিক বেকারি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েল ফুডের ম্যানেজার মো. মিজান টিবিএসকে বলেন, "যে অনুপাতে কাঁচামালের দাম বেড়েছে, সে অনুপাতে পণ্যের দাম বাড়ানো সম্ভব হয়নি। যেমন উপকরণের দাম ১০০ শতাংশ বাড়লেও উৎপাদিত পণ্যের দাম ৫০ শতাংশের বেশি বাড়ানো যায়নি।"
ব্রয়লার মুরগী ১১০ টাকা বেড়ে ২৩০ টাকা পৌঁছেছে। প্রতি হালি ব্রয়লার ডিম ৩২ টাকা থেকে বেড়ে ৪২ টাকায় পৌঁছেছে।
নগরীর জিইসি মোড়ের ক্যাফে আলম রেস্তোরাঁর ম্যানেজার ওমর ফারুক টিবিএসকে বলেন, "বর্তমানে বাজারে ৪০ টাকার কমে কোন সবজি নেই। অথচ মিষ্টি কুমড়া বা লাউয়ের মতো সবজি বছর দুয়েক আগেও ২০-৩০ টাকায় পাওয়া যেত। ঢেঁড়স ও বরবটি প্রতি কেজি ৭০-৮০ টাকা দরে খুচরায় বিক্রি হচ্ছে। এসব সবজির দাম শীতের শুরুতে নতুন বাজারে এলেও ৫০-৬০ টাকার বেশি দাম উঠতো না। কিন্তু এখন সব ধরণের সবজির দাম বেশি। ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে।"
নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারের মাল টানার মজুর আতাহার মিয়া বলেন, "এই কাঁচাবাজারে সবকিছুর দাম কম। এখানেও এক আঁটি লালশাকের দাম ২৫ টাকা। একটি পরিবারে অন্তত দুই আঁটি শাক রান্না করতে হয়। এখন শাক খেতেও ৫০ টাকা বাজেট করতে হয়। আমরা কোনভাবে বেঁচে আছি।"
দুই বছরের ব্যবধানে গরুর মাংস প্রতি কেজিতে ১৫০ টাকা হারে বেড়েছে। এ কারণে অনেক নিম্নবিত্ত পরিবারের রান্নার চুলায় অনেকদিন গরুর মাংস ওঠে না। বর্তমানে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ৭০০ টাকা।
ইট, বালু, মাটি টানার কাজ করেন পঞ্চাশোর্ধ্ব হারুন মিয়া। গত ছয় মাসে একদিনও বাসায় গরুর মাংস রান্না হয়নি তার। টিবিএসকে তিনি বলেন, "চুক্তিভিত্তিক ইট, বালু মাটি টানি। পরিশ্রমের কাজ বলে মাসে ২০ দিন কাজ করতে পারি। পরিবারে সাতজনের খাবার খরচ আমার আয়ে চলে। এক বছর আগেও সপ্তাহে তিনদিন মাছ-মাংস খেতে পারতাম। মাসে অন্তত দু'বার গরুর মাংস রান্না হতো। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম এতো বেড়েছে যে, সপ্তাহে একদিন মাছ-মাংস কিনতে কষ্ট হয়। গত ছয় মাসে গরুর মাংস রান্না হয়নি।"