উন্নত যোগাযোগের লক্ষ্যে পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে-মাদানি এভিনিউ সংযোগ সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার পাশে ৩০০ ফুট সড়ক হিসেবে পরিচিত পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ের ওপর যানবাহনের চাপ কমাতে মাদানি এভিনিউয়ের সঙ্গে দুইটি সংযোগ সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে সরকার।
প্রস্তাবিত সড়কের কাজ শেষ হলে পূর্বাচল থেকে কুড়িল বিশ্বরোড না গিয়ে বেরাইদ ও নতুন বাজার হয়ে গুলশান-২ বা রামপুরা রোডে যাতায়াত করা সম্ভব হবে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল নতুন শহর ইউসুফগঞ্জ প্রকল্প হয়ে মাদানি এভিনিউ পর্যন্ত সড়কটির দৈর্ঘ্য হবে ৩.৩ কিলোমিটার। আর পোশি, কেয়ারিয়া, জলসিড়ি আবাসন প্রকল্প হয়ে প্রস্তাবিত সংযোগ সড়কের দৈর্ঘ্য ৫.২৩ কিলোমিটার।
৮.৫৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়কের পাশাপাশি চারটি সেতু ও দুটি কালভার্ট নির্মাণে মোট ২৭২ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। ২০২৫ সালের মধ্যে এর কাজ শেষ করতে চায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।
প্রস্তাবের ওপর গত মাসে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভার আয়োজন করে পরিকল্পনা কমিশন। কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রকল্পটির বেশকিছু খাতে বাড়তি ব্যয় নিয়ে আপত্তি করা হয়।
সভায় বলা হয়েছে, ৮.৫৩ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে ১১৯.৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে, যেখানে প্রতি কিলোমিটারে লাগছে ১৪.০৫ কোটি টাকা। অথচ 'ঢাকা বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়ক প্রশস্তকরণ ও শক্তিশালীকরণ' শীর্ষক প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ধরা আছে ১.৪৫ কোটি টাকা।
এলজিইডির এই সড়কে ব্যয় অত্যাধিক ধরা হয়েছে বলে মনে করে পরিকল্পনা কমিশন।
একইসঙ্গে ২৮৯ মিটার সেতু নির্মাণে কিলোমিটারে ৫০ লাখ টাকা হিসেবে মোট ১৪৪.৫০ কোটি টাকা চেয়েছে এলজিইডি। সংস্থাটির সমজাতীয় প্রকল্পে প্রতি মিটার সেতু নির্মাণে ১১ থেকে ১৬ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হচ্ছে।
সড়ক ও সেতুর ব্যয় কমিয়ে আনার পাশাপাশি পরামর্শক, অফিস সরঞ্জামাদি, গাড়ি ভাড়া, যন্ত্রপাতি খাতে ব্যয় কমানোর শর্তে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জনিয়েছেন।
প্রকল্পটির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংযোগ সড়ক দুটি পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়ক এবং মাদানি এভিনিউ সড়কের ট্রাফিক ডাইভার্সনের জন্য বিকল্প সড়ক হিসেবে কাজ করবে। এর ফলে ঢাকা শহরের সাথে পার্শ্ববর্তী এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে, সেইসাথে অর্থনৈতিক গতিশীলতা বাড়বে। এর মাধ্যমে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
এতে আরও বলা হয়, নারায়ণগঞ্জের অত্যন্ত জনবহুল এলাকা রূপগঞ্জে প্রচুর আবাসন প্রকল্প ও শিল্প কারখানা গড়ে উঠলেও এ এলাকায় সংযোগকারী সড়কের সংখ্যা খুবই কম। পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়কের সঙ্গে মাদানি এভিনিউয়ের সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে ঢাকার পূর্বাচল বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সম্ভব।
প্রকল্পটির লক্ষ্য হল রাস্তাগুলোকে ১০০ ফুট প্রশস্ত করা। প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুসারে, এর মাধ্যমে গাড়ির গতি বৃদ্ধির পাশাপাশি সময় এবং জ্বালানি সাশ্রয়ের মাধ্যমে বার্ষিক ১৩৮ কোটি টাকার অর্থনৈতিক সুবিধা তৈরি হবে।
এতে বলা হয়, দুই রাস্তায় প্রতিদিন গড়ে ২,২৪১টি গাড়ি চলাচল করে, যেখানে জ্বালানী ব্যবহার হয় ৯৪৩৮ লিটার। রাস্তাটি প্রশস্ত করা হলে দৈনিক ২৮৩১ লিটার জ্বালানী সাশ্রয় হবে। প্রতি লিটার ৮০ টাকা ধরে বছরে জ্বালানী বাবদ সাশ্রয় হয় ১২২.৩০ কোটি টাকা।
অন্যদিকে দৈনিক মোট ৪৯৫৬ জন যাত্রী এই রাস্তাটিতে তিন ঘণ্টা হিসেবে মোট সময় ব্যয় করছেন ১৪,৮৬৮ ঘণ্টা। যাত্রার সময় অর্ধেকে নেমে আসলে দৈনিক সাশ্রয় হবে ৭৪৩৪ কর্মঘণ্টা। এ হিসাবে এক বছরে সাশ্রয় হবে ২২৩০২০ কর্মদিন, যার অর্থনৈতিক মূল্য ১৫.৬১ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা কমিশনের আরও আপত্তি
৮.৫৩ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ১.২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৪ মাসের জন্য দুইজন পরামর্শক নিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে প্রকল্পে।
আড়াই লাখ টাকা মাসিক বেতনে এই পরামর্শক নিয়োগে আপত্তি জানিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় যেসব কাজ করা হবে সেগুলো এলজিইডির নিজস্ব কাজের অন্তর্ভুক্ত। এ পরিপ্রেক্ষিতে পরামর্শক নিয়োগের যৌক্তিকতা জানতে চায় কমিশন।
প্রকল্পের আওতায় প্রকৌশল ও অন্যান্য সরঞ্জাম সংগ্রহ বাবদ ২০ লাখ, ভ্রমণ ব্যয় বাবদ ১০ লাখ, জিপ কেনায় প্রায় কোটি টাকা বরাদ্দ সত্ত্বেও যানবাহন ভাড়ায় ১২ লাখ, কম্পিউটার ও অফিস সরঞ্জাম বাবদ চার লাখ, অফিস সরঞ্জাামাদি বাবদ ৪ লাখ, আসবাবপত্র বাবদ ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
এছাড়া ফিজিক্যাল কন্টিনজেন্সি ও প্রাইস কনটিনজেন্সি বাবদ আরও প্রায় ২ কোটি টাকা দাবির বিষয়েও আপত্তি রয়েছে কমিশনের।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
প্রকল্পটিতে এলজিইডির সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন রূপগঞ্জ জলশিরি আবাসন সংযোগ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক জি এম মুজিবুর রহমান।
তিনি বলেন, সমজাতীয় প্রকল্পগুলোর আওতায় এলজিইডি ১০ থেকে ১৫ ফুট প্রশস্ততার সড়ক নির্মাণ করছে। আর প্রস্তাবিত প্রকল্পে ১০০ ফুট প্রশস্ততার সড়ক নির্মাণ করায় ব্যয় তুলনামূলক বেশি হচ্ছে। একইসঙ্গে সেতুর প্রশস্ততা ৩০ ফুটের বেশি হওয়ায় মিটারপ্রতি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে বলে তিনি জানান।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের পরিবহন সমন্বয় উইংয়ের যুগ্ম প্রধান আবু মো: মহিউদ্দিন কাদেরী জানান, পিইসি সভায় বিভিন্ন খাতে অযৌক্তিক ব্যয় প্রস্তাবের বিষয়টি পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং এলজিইডির পক্ষ থেকে কিছু বিষয়ে জবাবও দেওয়া হয়েছে সভায়।
বিভিন্ন খাতে ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে এনে ডিপিপি পুনর্গঠনের শর্তে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদনের সুপারিশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, "রাজধানীর পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে সড়ক অবকাঠামো প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এ হিসাবে পূর্ব পশ্চিম এলাইনমেন্টের দুইটি সড়কের সংযোগ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ ধরনের প্রকল্প নেওয়ার আগে ব্যয়ের বিষয়টি অবশ্যই ভাবতে হবে।"
তিনি বলেন, বাংলাদেশে সড়কের প্রকল্পের ব্যয়ের বড় অংশই চলে যায় ভূমি অধিগ্রহণে। প্রস্তাবিত প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ না থাকা সত্তেও বিশাল ব্যয়ের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে বলেও তিনি জানান।