স্বাধীন ট্রেকারদের জন্য স্বর্গ ছিল নেপাল, তাও কেন একাকি ট্রেকিং নিষিদ্ধ করেছে দেশটি?
প্রায় বছর তিরিশেক আগে একবার নেপালের অন্নপূর্ণায় গিয়েছিলাম। ওই সময় দেশটিতে কেউ ট্রেকিং করতে চাইলে স্রেফ অভিবাসন বিভাগ থেকে একটা অনুমোদনপত্র নিলেই হতো।
ওই অনুমতি নিতে ঝামেলা পোহাতেও হয়নি একদম — নেপালের আমলাতন্ত্র বেশ সদয় ছিল। পোখারা পর্যন্ত বাসে গিয়েছিলাম। এরপর হ্রদের পাশে এক ছোট্ট শহরে ট্রেকিং করে বেড়াই।
ঘান্ড্রুক ও ছোমরং নামক দুটো অনিন্দ্য সুন্দর গ্রামের আশেপাশে দারুণ সব ট্রেকিংয়ের পথ — এ পথগুলোর ব্যবস্থাপনাও বেশ ভালো।
বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতগুলো দেখতে দেখতে এ ট্রেকিংয়ের অনুভূতি ছিল এক কথায় স্বর্গীয়। সারাদিন হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেলে কোনো একটা লজে ঢুকে পড়তাম।
এসব লজে আগে থেকে কক্ষ ঠিক করে রাখার উপদ্রব ছিল না। যেকোনো সময়ই খাবার আর আশ্রয় পাওয়া যেত। তাই ট্রেকিংয়ের সময় খাবারভর্তি ব্যাগ, ক্যাস্পিংয়ের জন্য জিনিসপত্র বহনের কষ্ট ছিল না।
এ ধরনের ট্রিপের জন্য অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি গড়ে উঠেছে নেপালে। দেশটিতে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রাস্তাগুলো কয়েক শতক আগে ব্যবহার করতেন বণিকেরা।
তবে এপ্রিল থেকে ট্রেকারদের জন্য এমন সুযোগ আর থাকছে না। নেপাল ট্যুরিজম বোর্ড (এনটিবি) গত মার্চে ঘোষণা দিয়েছিল, এখন থেকে বিদেশি ট্রেকারদেরকে কেবল তখনই অনুমতি দেওয়া হবে যদি তারা একজন লাইসেন্সধারী গাইডকে নিজেদের সঙ্গে ট্রেকিংয়ে নেন।
নেপালের অন্নপূর্ণা, ল্যাংট্যাং, মাকালু-বরুণ ও কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ বিভিন্ন জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষণ এলাকা বিদেশি স্বাধীন ট্রেকারদের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয়। কিন্তু এ আদেশের পর এখন থেকে আর নিজেদের মতো করে এসব অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন না তারা।
নেপালের এ সিদ্ধান্তের পেছনে দুটো বড় কারণ রয়েছে। প্রথমত, কর্তৃপক্ষ নেপালে ট্রেকিংকে আরও নিরাপদ করে তুলতে চায়। আর দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, এর মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে চাইছে দেশটি।
বেশ কয়েকজন মার্কিন ট্রেকার নেপালে ট্রেকিং করতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়ার কথা জানা গেছে অতীতে। এরপর থেকে দেশটিতে একা ট্রেকিং করার ব্যাপারে বারবার সতর্ক করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস।
একজন পর্বতারোহী ও একজন ট্রেকার হিসেবে স্বভাবতই এ খবরে আমার মন খারাপ হয়েছে। হিমালয়ের পাহাড়গুলো একাকি উপভোগ করার স্বাধীনতা ক্রমশ বন্দি হচ্ছে লালফিতায়। অন্যদিকে নেপালের দরিদ্রতা নিয়ে আমার ভালোই ধারণা আছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, কর্মসংস্থান বাড়ানোর এ উদ্যোগকে প্রশংসাই করব আমি।
স্বাভাবিকভাবেই নেপালের পর্যটনশিল্প সংশ্লিষ্ট মানুষেরা এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। 'এটি স্থানীয়দের জন্য অনেক বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করবে এবং পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তাকেও বাড়িয়ে তুলবে,' বলেন রয়্যাল মাউন্টেইন ট্রাভেল-এর মালিক শিবা ধাকাল।
কিন্তু অভিজ্ঞ ট্রেকারদের যারা একা ভ্রমণ পছন্দ করেন, তারা হয়তো এ সিদ্ধান্তের কারণে এখন নেপাল থেকে মুখ ফেরাবেন।
তবে বর্তমানে নেপালে যারা ট্রেকিং করছেন, এদের বেশিরভাগেরই ট্রেকিংয়ের অভিজ্ঞতা কম। তারা ট্রেকিংয়ের বিভিন্ন প্যাকেজ কিনে জনপ্রিয় এভারেস্ট বেসক্যাম্পের মতো জনপ্রিয় স্থানগুলোতে ভ্রমণে যান। এসব প্যাকেজে স্বাভাবিকভাবেই গাইডেরা থাকেন।
তবে গাইড নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হলে যে নিরাপত্তা বাড়বে এ ব্যাপারে এখনো সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। নেপালকে এখন অনেক বেশি করে ট্রেকিং গাইডের প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। নেপালের সরকারের যে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা আছে, সেখান থেকে যেসব গাইড বের হন, তারা হিমালয়ের পরিবেশে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত নন।
অন্যদিকে নেপালের পর্যটন মন্ত্রণালয়েরও নিরাপত্তা বিষয়ের রেকর্ড আহামরি ভালো নয়। এ মন্ত্রণালয় দেশটির বিমান পরিবহনও দেখাশোনা করে। গত জানুয়ারিতে ইয়েতি এয়ারলাইন্স-এর একটি এটিআর ৭২-৫০০ বিমান পোখারায় অবতরণ করতে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়েছে। ওই দুর্ঘটনায় বিমানে থাকা ৭২ জন সবাই মারা যান। এর আগেও দেশটিতে বিমান দুর্ঘটনার অনেক নজির রয়েছে।
২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে নেপালের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্রেকিং দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সাইক্লোন হুদহুদ সেবার ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে অন্নপূর্ণা এলাকায় ছয় ফুটের মতো বরফের স্তর তৈরি করেছিল।
তখন কমপক্ষে ৪৩ জন মারা গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে অর্ধেকের মতো ছিলেন নেপালি ট্রেকিং গাইড ও অন্যান্য পর্যটনকর্মী। তবে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা কখনোই জানা যায়নি। নেপাল এ ইতিহাস থেকে কতটা শিক্ষা নিয়ে নিজেদের ব্যর্থতাগুলো উতরেতে পেরেছে তা আমরা ভবিষ্যতে জানতে পারব।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।