আলমগীর কবির ‘মোহনা’ নির্মাণ করেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ’র ঘটনা নিয়ে!
আলমগীর কবির ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। তারপর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গিয়েছিলেন। আর সে সময়েই তিনি ইঙ্গমার বার্গম্যানের সেভেন্থ সিল দেখার সুযোগ পান। ছবিটা দেখে তিনি এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে বেশ কয়েকবার দেখেন। তারপর তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতি আকৃষ্ট হন। আলমগীর কবির ইংল্যান্ডের কম্যুনিস্ট পার্টিরও সদস্য হয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে দেশে ফেরার পরে বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে আইয়ুব সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৭১ সালে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ইংরেজি বিভাগে প্রধান হিসেবে যোগ দেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আলমগীর কবির পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। তার নির্মিত ধীরে বহে মেঘনা, সূর্য কন্যা, সীমানা পেরিয়ে ইত্যাদি ছবিগুলো প্রশংসিত হয়। ১৯৮২ সালে তিনি মোহনা চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য রচয়িতার পুরস্কার লাভ করেছিলেন এ ছবির জন্য। ছবিটির জন্যই তিনি মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ডিপ্লোমা অব মেরিট লাভ করেন।
আলোকচিত্রী এবং চলচ্চিত্র গবেষক মীর শামসুল আলম বাবুর ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা যাচ্ছে, সদ্য প্রয়াত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ঘটনা নিয়েই ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন আলমগীর কবির। ছবিটির কাহিনীসূত্র (সিনপসিস) এমন: বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অল্পকাল পরে ডাক্তার, সেবিকা ও সমাজকর্মীদের একটি দল প্রত্যন্ত কোনো গ্রামে যায় এবং একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। ইংল্যান্ডে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার মোস্তফা দলটির নেতা। চিকিৎসা সেবা দেওয়ার চেয়েও তার সমাজবদল বিষয়ে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি চাইছেন অজ্ঞতা দূর করতে এবং গ্রামবাসীকে স্বনির্ভর করে তুলতে যেন তারা ক্ষুধার কাছে পরাজিত না হন। সাধারণ গ্রামবাসী তাদেরকে স্বাগত জানালেও গ্রামের মাতব্বররা বিরক্ত হন। তারা দলটিকে বিব্রত করতে থাকেন এবং গ্রাম ছাড়া করতে চান।'
জাফরুল্লাহ ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় তিনি কলেজের দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। পরে কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকও হয়েছিলেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ পড়া শেষ করে তিনি যুক্তরাজ্যে যান এবং সেখানে সার্জন হিসাবে সুনাম লাভ করেন। সেটা ছিল '৬৯ সাল। জাফরুল্লাহ সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। যুদ্ধকালীন গড়ে তোলেন বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বিলাতে না গিয়ে দেশেই সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে শুরু করলেন। বাংলাদেশে ১৯৮২ সালে চালু হওয়া 'জাতীয় ঔষধ নীতি' প্রণয়নে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। ছাত্রজীবনে তিনি বাম ধারার রাজনীতি করেছেন, তবে পরে সেভাবে আর সক্রিয় রাজনীতি করেননি। স্বাস্থ্য নীতি, ঔষধ নীতি ও নারী শিক্ষা নিয়ে তিনি সরকারকে প্রভাবিত করেছেন। ব্যতিক্রমী এক নির্মোহ মানুষ ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ।
ডা. জাফরুল্লাহ এবং চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের ব্যক্তিজীবনেও দারুণ মিল লক্ষ করা যায়। তারা দুজনেই বিলাতে পড়তে গিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন, বামপন্থী চিন্তাধারায় লালিত হয়েছেন, দেশ গঠনে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন।