রাউজানে মহাসড়কের পাশে বাঙ্গি-তরমুজের হাট, মৌসুমে আড়াই কোটি টাকার ব্যবসা
কাকডাকা ভোরে মহাসড়কের দুই পাশে শুরু হয় সবুজ-হলুদ বাহারি রঙের মৌসুমি ফলের হাট। দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই চাষীরা ক্ষেত থেকে তুলে নিয়ে আসেন তরতাজা বাঙ্গি-তরমুজ। দিনভর পথচারী আর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বেপারীদের পদচারণায় মুখরিত হয় মহাসড়কের দুই পাশ। এমন দৃশ্যের দেখা মেলে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি মহাসড়কের রাউজানের কুণ্ডেস্বরী এলাকায়।
রাউজান উপজেলার সুলতানপুর, ইদলপুর, কদলপুর, পূর্ব গহিরা, বিনাজুরি ও ডাবুয়াসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এই হাটে বাঙ্গি আর তরমুজ নিয়ে আসেন কৃষকরা। ভোর থেকে বিকিকিনি চলে রাত অবধি; বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেচাকেনার ধুম পড়ে যায়। মার্চের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিল; এই দেড় মাস সময়ে এই অস্থায়ী হাটে প্রায় আড়াই কোটি টাকার ব্যবসা হয় বলে দাবি করছেন কৃষকরা।
রাউজানের বাঙ্গি-তরমুজের সুনাম সারা দেশ জুড়ে। প্রায় ৪০ বছর ধরে প্রতি মৌসুমে এই অস্থায়ী হাটে বাঙ্গি-তরমুজ বিক্রি হয়ে আসছে। দূর-দূরান্ত থেকে পাইকারি ক্রেতারা হাজির হন এই হাটে। আসেন আশপাশের এলাকার খুচরা ক্রেতারাও। যানবাহন থামিয়েও অনেক যাত্রী বাঙ্গি-তরমুজ কিনে নিয়ে যান। সরাসরি ভোক্তার কাছে ন্যায্য দামে ফসল বিক্রি করতে পেরে চাষির মুখে হাসির থাকে ঝিলিক।
সম্প্রতি রাউজানের কুণ্ডেশ্বরী সংলগ্ন শরতের দোকান এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শ্রমিকরা কাঁধে করে সরাসরি ক্ষেত থেকে তরমুজ ও বাঙ্গি নিয়ে এনে রাখছেন মহাসড়কের পাশে। সড়কের দুই পাশে গড়ে উঠেছে বাঙ্গি ও তরমুজের স্তূপ। দুপুর হতেই ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে সরগরম হয়ে উঠে পুরো এলাকা। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা দামদর করে স্তূপ থেকে ১০০ পিস হিসেবে বাঙ্গি ও তরমুজ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রতি ১০০ পিস তরমুজ ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মাঝারি আকারের ১০০ পিস বাঙ্গির দাম সাড়ে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা।
সকাল ১০টার দিকে সেখানে বাঙ্গি ক্রয় করছিলেন স্কুল শিক্ষিকা শ্যামলি দত্ত। তিনি বলেন, 'প্রায় প্রতিদিনই এই সড়ক দিয়ে যাবার সময় রসালো এই ফলগুলো সাজিয়ে রাখতে দেখতে পাই। আজ বাড়ির জন্য একটি বাঙ্গি কিনে নিলাম। তরতাজা এইসব ফল যেমন দামে সস্থা, তেমনি মানে ভালো।'
কাপ্তাই এলাকার ফল ব্যবসায়ী আবদুল মালেক সড়কের পাশ থেকে বাঙ্গি কিনে সিএনজি অটোরিকশায় তুলছিলেন। গড়ে ১৮০ টাকা দরে ২০০টি মাঝারি আকারের বাঙ্গি কিনেছেন তিনি।
আবদুল মালেক বলেন, 'মৌসুমি ফল হওয়ায় অন্য ফলের তুলনায় বাঙ্গির চাহিদা বেশি। রমজান মাসে চাহিদার পরিমাণ আরও বেড়ে গেছে। চট্টগ্রামের পাইকারি আড়তগুলোর তুলনায় এ হাটে বাঙ্গির দাম ও মান দুটোই ভালো। তাই গেল কয়েক বছর ধরে এই হাট থেকেই তরমুজ-বাঙ্গি কিনছি।'
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাউজানের পাঁচটি ইউনিয়নে এবার প্রায় ৭০০ একর জমিতে তরমুজ ও বাঙ্গির আবাদ হয়েছে। রমজান ও পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে ভালোই দাম পেয়েছেন তারা।
কৃষক আবদুস সালাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্রায় ৪০ বছর ধরে বাঙ্গি-তরমুজের চাষ করছি। বাপ-দাদারা করছেন তারও আগ থেকে। বছর বিশেক আগেও স্থানীয়দের জন্য সড়কের পাশে বাঙ্গি-তরমুজ বিক্রি করতেন কৃষকরা। তখন হাতে গোনা ১০-১২ জন কৃষক তাদের উৎপাদিত বাঙ্গি ও তরমুজ নিয়ে আসতেন এ হাটে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে রাউজানের বাঙ্গি-তরমুজের সুনাম। গত কয়েক বছরের সড়কের ধারেই হাটের পরিধি ব্যাপক বেড়েছে। এখন প্রতিদিন এ হাটে তিন থেকে চার লাখ টাকার বাঙ্গি-তরমুজ বিক্রি হয়।'
তিনি জানান, চলতি বছর প্রায় তিন একর জমিতে তরমুজ ও বাঙ্গি চাষ করেছিলেন। শিলাবৃষ্টিতে তরমুজ নষ্ট হলেও বাঙ্গির আবাদ ভালো হয়েছে। শুধু বাঙ্গি থেকেই প্রায় দুই লাখ টাকার মুনাফা হয়েছে চলতি বছর।
আরেক কৃষক দীপক ঘোষ টিবিএসকে বলেন, 'চলতি বছর দুই একর জমিতে বাঙ্গি ও এক একর জমিতে তরমুজের আবাদ করেছিলাম। পানির স্বল্পতায় তরমুজের ফলন তেমন ভালো হয়নি। তবে বাঙ্গিতে সেই লোকসান অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছি। আমাদের উৎপাদিত বাঙ্গি-তরমুজ প্রতিদিনই ঢাকা, বরিশাল, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে।'
এদিকে স্থানীয় কৃষকদের পাশাপাশি কৃষি বিভাগ উপজেলার ডাবুয়া, কুণ্ডেশ্বরী, কদলপুর ইউনিয়নের ৮৩ হেক্টর পতিত জমিতে তরমুজ ও বাঙ্গির আবাদ করেছে। বিষয়টি জানিয়ে উপজেলা কৃষি অফিসার ইমরান হোসাইন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্রবাসী অধ্যুষিত হওয়ায় রাউজানের অনেক জমিই অনাবাদি থেকে যায়। তাই এবার কৃষি বিভাগ নোয়াখালীর ৬ জন কৃষককে দিয়ে ৭২ হেক্টর জমিতে তরমুজ ও ২১ হেক্টর জমিতে বাঙ্গি আবাদ করানো হয়েছে।'
'উপজেলা কৃষি অফিস এসব কৃষককে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়েছে। জমিগুলো পতিত হলেও তরমুজ ও বাঙ্গি আবাদে ভালো ভল পাওয়া গেছে। প্রতি একরে ১২ থেকে ১৫ হাজার পিস তরমুজ ও প্রায় কাছাকাছি সংখ্যায় বাঙ্গি উৎপাদিত হচ্ছে। এসব তরমুজ ও বাঙ্গির প্রায় ৯৫ শতাংশ যাচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে', বলেন ইমরান হোসাইন।
সুলতানপুর এলাকার কৃষক ফারুক মিয়া টিবিএসকে বলেন, একসময় ডাবুয়া খালের পানি দিয়েই এই অঞ্চলের তরমুজ ও বাঙ্গির আবাদ হতো। কিন্তু গ্রীষ্মে খালে পানি পাওয়া যায় না। ডাবুয়া খালে স্লুইসগেট স্থাপন করা গেলে কৃষকরা পানির দুর্দশা থেকে রক্ষা পেতেন। এ সময় তিনি তরমুজ ও বাঙ্গি সংরক্ষণে উপজেলায় হিমাগার তৈরীরও দাবি জানান।