শিশুদের শিক্ষার ভার কেন এআই নিতে পারবে না, ঘাটতি কোথায়?
যুক্তরাষ্ট্রের রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক রিনা ব্লিস শিক্ষাক্ষেত্রে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার আর সীমাবদ্ধতা নিয়ে দীর্ঘকাল গবেষণা করেছেন। সম্প্রতি তিনি শিশু শিক্ষার বিষয়ে এই নিবন্ধটি লেখেন মার্কিন দৈনিক দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের মতামত কলামে। নিবন্ধের ভাবানূদিত অংশ টিবিএসের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো –
আমার যমজ সন্তান দুটি, পড়ছে কিন্ডারগার্টেনে। বেশিদিন আগের কথা নয়, একদিন তাদের একজনের স্কুলব্যাগ খালি করার সময় হঠাৎ হাতে এলো একটি প্যাকেট। মোড়কে আমার ছেলের নাম, কয়েক সিরিজ পাসকোড ও ডাউনলোড কোড লেখা।
আমি বেশ ধন্দে পড়লাম। কারণ আমি ও আমার স্বামী মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে বাচ্চাদের এখনই কম্পিউটার দরকার নেই। তাহলে কে দিল এই সামগ্রী। পরে জানলাম, স্কুল থেকেই দেওয়া – একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কোম্পানির পরীক্ষামূলক শিশু শিক্ষার উপকরণ; যার সাহায্যে আমার বাচ্চা নাকি নিজে থেকেই শিখতে পারবে – অভিভাবকদের কোনো সহায়তা নিতে হবে না।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই – সম্পর্কে নানান ভ্রান্ত ধারণা এবং এর বৈশিষ্ট্য নিয়ে কয়েক দশকের বেশি সময় গবেষণা করেছি। তাই অভিভাবক হিসেবে বেশ কৌতূহলই জাগলো। একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবেই আমার আগ্রহ ছিল – কীভাবে এই ব্যবস্থা কাজ করে তা জানতে। মনে প্রশ্ন জেগেছিল: সত্যিই কী এআই আমার বাচ্চাকে শেখাতে-পড়াতে পারবে?
তাছাড়া, আমি নিজে একটি বড় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, যেখানে নানান গবেষণার বাজেট বেশ আঁটসাঁটো। এআই শিক্ষা ব্যবস্থাকে কীভাবে রুপান্তর করবে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিদ্যাঙ্গনে তার কী অবদান যোগ হবে – শিক্ষক হিসেবে তা নিয়ে আমার আগ্রহ তৈরি হয়।
আমার মতো অনেক পেশাজীবী অভিভাবক আছেন, সন্তানদের পাঠ সহায়তা দিতে যাদের কাজের ব্যস্ততা থেকে সময় বের করে নিতে হয়। ফলে প্রযুক্তিটি সফল হলে এমন অভিভাবকদের ভার লাঘব হবে বলে বোধ করি।
আরো প্রশ্ন জাগে, শিশুদের নিত্যনতুন কনসেপট শেখাতে ও তাদের সেসব সম্পর্কে দক্ষতা তৈরিতে – আমার মতোন ব্যস্ত অভিভাবকদের যখন প্রায়শই হিমশিম খাওয়ার যোগাড় হয়, তখন এআই কি উদ্ধারকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করবে? শিশুদের নিজস্ব মেধাকে কাজে লাগাতে এআই কি সাহায্য করতে পারবে?
এরপর কেটে যায় হপ্তাকয়েক। এরমধ্যে আমার চঞ্চল দুই যমজ সন্তানের পড়াশোনা (আদতে নতুন ডিভাইসে ক্লিক আর স্ক্রোল) দেখে সব প্রশ্নেরই উত্তর পাই। উত্তর হলো স্রেফ- 'না'।
একটা কথা জানিয়ে রাখি আপনাদের, আমি কিন্তু এআই-বিরোধী শিবিরের নই। আমাদের বাড়িটি এরমধ্যেই এ প্রযুক্তির অজস্র উপকরণে ঠাঁসা। আমার পরিবারের প্রায় সকল সদস্যই কর্মক্ষেত্রে এআই প্রোগ্রাম ব্যবহার করে। এমনকী প্রায়ই আমাদের তিন সন্তানকে – দুই যমজ ও তাদের ছোট্ট ভাইটিকে – তাদের প্রজেক্ট আমাদের ডিজিটাল ডিভাইস দিয়ে করার সুযোগ দেই।
২০২১ সালেই বাজারে 'ডল-ই' আনে বিশ্বের প্রথমসারির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ল্যাব- ওপেনএআই। এরপর আমার দাদু বাচ্চাদের এটি দিয়ে ছবি আঁকা শেখাতে শুরু করেন। গত বছর যখন সংস্থাটি চ্যাটজিপিটি লঞ্চ করে, তারপর আমার স্বামী অতি-উৎসাহের সাথে বাচ্চাদের নিয়ে মেতে ওঠেন। কিংবদন্তির তুষারমানব ইয়েতি আসলে কেমন, কোথায় তার বাস এমন নানান প্রশ্নে চ্যাটজিপিটিও যেন জেরবার।
এক কথায়, মজার খেলার ছলে বাচ্চাদের এআই সম্পর্কে আগ্রহী করতে, বা তাদের কৌতূহল জাগাতে আমরা মোটেও কার্পণ্য করিনি কস্মিনকালে। আবার মজাও করেছি।
বাচ্চাদের এসব প্রযুক্তি ব্যবহার দেখে একটা বিষয়ই আমার কাছে স্পষ্টতর হয়েছে, তা হলো – ছাত্রের কাছে তথ্য পৌঁছে দিতে পারে এআই, কিন্তু তাদের হয়ে চিন্তার কাজটা করতে পারে না। অর্থাৎ, প্রকৃতপক্ষে তাদের শেখাতে পারে না।
মানব বুদ্ধিমত্তা কম্পিউটার বা যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তার থেকে অনেক আলাদা। প্রথমত মানব বুদ্ধিমত্তা পরিমাপযোগ্য নয়। আমাদের মগজ প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শিখছে, আর সেই অনুপাতে তার বিকাশ ঘটছে। আমরা চারপাশের পরিবেশ থেকেও প্রতিনিয়ত শিখছি।
দ্বিতীয়ত, মানব বুদ্ধিমত্তা মানবিক আদানপ্রদানের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ, সামাজিকভাবে আমরা একে-অন্যের সাথে ভাব আদানপ্রদানের মাধ্যমে বুদ্ধিকে বিকশিত করি। শিশুদের ক্ষেত্রে যা পরম সত্য। প্রাকৃতিকভাবেই এই কাজটা আমরা বাল্যকালে শিখি। সেই আঙ্গিকেই আমাদের চারপাশের জগতের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, বা তার সম্পর্কে আমাদের বিভিন্ন ধ্যান-ধারণার উদ্ভব হয়।
এভাবে জানা ও শেখার চালিকাশক্তির সাথে আমরা সবাই যুক্ত। জন্মসূত্রে মানবশিশুর এভাবে শিখে নেওয়ার বৈশিষ্ট্য থাকলেও – তা থাকে সুপ্ত। সেই দরজাটাই খুলে দিতে হয় তার নিকটজনদের। শিশুর মধ্যে জানাবোঝার আগ্রহ ও প্যাশন তৈরির গুরুদায়িত্ব নিতে হয়। সামাজিক-আবেগীয় এই অংশটি ছাড়া শুধু তথ্য পরিবেশন কাজের নয়। ফলে এই তথ্য থেকে শিক্ষা অর্জিত হয় না, ফলে দ্রুতই সেটা ভুলেও যায় শিশুরা।