মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন: স্পিন-অফের জাদু যখন মূল সিরিজকে ছাপিয়ে যায়
'সিন্ডিকেট' ওয়েব সিরিজের অ্যালেন স্বপনকে কেন্দ্র করে স্পিন-অফ সিরিজের কথা শুনে প্রথমেই মাথায় এসেছিল 'বব বিশ্বাস'-এর নাম।
পশ্চিমা বিশ্বের শত শত স্পিন-অফ টিভি শো আর পূর্ণদৈর্ঘ্য ফিচার ফিল্ম থাকলেও সুজয় ঘোষ পরিচালিত ২০১২ সালের থ্রিলার 'কাহানি'র স্পিন-অফ বব বিশ্বাসের সঙ্গে অ্যালেন স্বপনের সাদৃশ্য সবচেয়ে বেশি৷
২০২২ সালে নির্মিত শিহাব শাহীনের ক্রাইম থ্রিলার সিন্ডিকেট এর স্বপনের মতো কাহানিতে বব বিশ্বাসের চরিত্রটিরও বিস্তার ছিল নিতান্তই সীমিত পরিসরে।
কিন্তু তারপরও, অল্প সময়ের জন্য জায়গা পেয়েও নিজের অসামান্য অভিনয় দক্ষতায় দর্শকের মনে দাগ কাটতে পেরেছিলেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। তাই তো প্রায় এক দশক পর ওই বব বিশ্বাস চরিত্রটিকে কেন্দ্র করেই একটি আস্ত ছবি বানিয়ে মুক্তি দেওয়া হয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম জি ফাইভে।
তবে মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন আর বব বিশ্বাসের মধ্যে কিছু বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে।
প্রথমত, নিজের চরিত্রটিকে নতুন করে ডানা মেলে দর্শকের সামনে হাজির হতে পুরোপুরি এক বছরও অপেক্ষা করতে হয়নি অ্যালেন স্বপনকে। পরিচালক শিহাব শাহীন বেশ ভালোভাবেই ধরতে পারেন দেশি দর্শকদের পালস। তাই অ্যালেন স্বপনকে নিয়ে দর্শকের উন্মাদনা থিতিয়ে যাওয়ার আগেই তাকে নিয়ে সিরিজ বানিয়ে ফেলেছেন তিনি।
দ্বিতীয়ত, বেশি দর্শক টানার লক্ষ্যে বব বিশ্বাস ছবিতে শাশ্বতের জায়গায় অভিষেক বচ্চনকে নেওয়া হলেও, মাইশেলফ অ্যালেন স্বপনে কিন্তু রাখা হয়েছে 'আসল' স্বপন তথা নাসির উদ্দিন খানকেই।
আর মোটা দাগে এই দুইটি ব্যাপারই আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, কেন দর্শক বব বিশ্বাসের মতো বিশাল ক্যানভাসের ছবি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও, ঠিকই সাদরে গ্রহণ করেছে অপেক্ষাকৃত ছোট পরিসরের সিরিজ মাইশেলফ অ্যালেন স্বপনকে। চাঁদ রাতে স্ট্রিমিং শুরু হওয়ার পর থেকে এই সিরিজকে কেন্দ্র করে দর্শকের উন্মাদনা উত্তরোত্তর যেন বেড়েই চলেছে।
শাহীন যদি মাইশেলফ অ্যালেন স্বপনের জন্য আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতেন, তাহলে নি:সন্দেহে এখনের মতো এতটা সাড়া পেতেন না তিনি দর্শকের কাছ থেকে। কারণ, আজকাল তো দর্শকের সামনে 'দেখার মতো' নতুন নতুন সিনেমা-সিরিজের অভাব নেই। কাঁহাতক আর তারা একটি চরিত্রকে নিয়ে পড়ে থাকবে!
আর তারচেয়েও বড় কথা, অতি লোভ করতে গিয়ে শাহীন যদি নাসিরকে সরিয়ে আরো বড় কোনো নামকে অ্যালেন স্বপন চরিত্রের জন্য কাস্ট করতেন, সেই সিদ্ধান্তও বুমেরাং হতো তার জন্য।
কেননা, নাসির তার নিজস্বতা দিয়েই বাজিমাত করেছেন স্বপন চরিত্রে; দাগ কেটেছেন দর্শকের মনে। তার জায়গায় অন্য যত বড় আর অভিজ্ঞ অভিনেতাকেই আনা হতো না কেন, তিনি কোনোভাবেই স্বপনের যোগ্য বিকল্প হয়ে উঠতে পারতেন না।
মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন মূলত স্বপন চরিত্রটির অরিজিন স্টোরি বলে। তবে আগ্রহোদ্দীপক ব্যাপার হলো, এর পটভূমি ২০১৮ সাল, যখন মাদকের বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল বাংলাদেশ সরকার।
ওই সময় খবর চাউর হয়, কক্সবাজারে কথিত ক্রসফায়ারে খুন হয়েছে কুখ্যাত ড্রাগ ডিলার অ্যালেন স্বপন। আর তার দিনকয়েকের মধ্যেই, হুবহু স্বপনের মতো দেখতে, শামসুর রহমান নামে এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে রাজধানী ঢাকার বুকে।
কাহিনি যত এগোয়, আমরা সাক্ষী হতে থাকি স্বপনের অবিশ্বাস্য মেটামরফোসিসের। ক্রমশ এক আদ্যপান্ত ফ্যামিলি ম্যান হয়ে ওঠে সে। ইন্স্যুরেন্স এজেন্ট হিসেবেও নিজেকে মানিয়ে নিতে থাকে। সেই সঙ্গে অচিরেই সে জড়িয়ে পড়ে ব্যাংকিং সেক্টরের মানি লন্ডারিং সিন্ডিকেটে, যার উল্লেখ আমরা আগেই পেয়েছি এই স্পিন-অফ সিরিজের পূর্বসূরি সিন্ডিকেটে।
নাসিরের মতো এতটা নিবেদিতপ্রাণ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও সাহসী অভিনেতার পক্ষেই সম্ভব স্বপনের মতো একটি চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা।
নাসির তার প্রাণবন্ত চাঁটগাইয়া উচ্চারণ দিয়ে কমেডি দৃশ্যে যেমন দুর্দান্ত ছিলেন তেমনি সিরিয়াস দৃশ্যগুলোতেও ছিলেন বেশ প্রভাবশালী। তার প্রতিভার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ দেখা যায় সিজনের শেষের দিকের নির্দিষ্ট কিছু সিকুয়েন্সে শুধু তার চোখের অভিনয়েই।
স্বপন চরিত্রটি যেন সৃষ্টিই হয়েছিল নাসিরের জন্য৷ তিনিও তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন পর্দায় চরিত্রটির পূর্ণতা দিতে। এর সফলতার উপরই যে ভবিষ্যতে তার জন্য আরোও অনেক সুযোগ অপেক্ষা করছে তা ভালোভাবেই বুঝেছিলেন নাসির।
সিরিজের দ্বিতীয় সেরা অভিনেতা ছিলেন স্বপনের ছেলে জাদুর চরিত্রে অভিনয় লরা আব্দুল্লাহ আল সেন্টু। তার শূন্য দৃষ্টি আর অকৃত্রিম ডায়লগ ডেলিভারি নিঃসন্দেহে ছিল চোখের শান্তি। বাংকার বয়, শুক্লপক্ষ আর কারাগারের পর আরো একটি দুর্দান্ত পারফরমেন্সে সেন্টু ইন্ডাস্ট্রিতে তার জায়গা আরো পাকাপোক্ত করেছেন।
শামসুর রহমানের স্ত্রী শায়লার চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাফিয়াত রশিদ মিথিলা। গুরুত্বপূর্ণ এই চরিত্রটি ছিল নানান স্তর আর আবছায়ায় পরিপূর্ণ। বিস্তৃত আবেগ লুকিয়ে রাখতে হয়েছে তাকে। শায়লা চরিত্রের সবগুলো দিকই ভালোভাবে সামলেছেন মিথিলা।
এতবছর ইন্ডাস্ট্রিতে থাকার পরও তার মতো প্রতিভাধর শিল্পীর সদ্ব্যবহার হয়নি, যা বেশ দূর্ভাগ্যজনক। এখন যেহেতু তিনি অভিনয়ে নিয়মিত হয়েছেন তাই আশা করা যায় এমন আরো বৈচিত্র্যময় চরিত্রে শীঘ্রই দেখা যাবে তাকে।
মিথিলা, নাসিরসহ সিরিজের সকল অভিনয় শিল্পীকে সর্বোচ্চ কাজে লাগানোর কৃতিত্ব অবশ্যই পরিচালন শিহাব শাহীনের। কিন্তু সর্বপ্রথম সিন্ডিকেটের একটি চরিত্রের বিপুল জনপ্রিয়তাকে আমলে নিয়ে সেটিকে কেন্দ্র করে একটি গোটা সিরিজ নির্মাণের উদ্যোগের জন্য তার সাধুবাদ পাওনা। এবং এক্ষেত্রে তিনি যোগ্য সমর্থন পেয়েছেন রবিউল আলম রবির।
তবে মূল গল্পটি বেশ ভালো হলেও শিহাব শাহীনের লেখা চিত্রনাট্যটি আরো আঁটসাঁট হওয়া উচিত ছিল। নতুন 'ইউনিভার্স' তৈরির স্বার্থে সিরিজের প্রথম তিনটি এপিসোড খানিকটা ধীর গতির হলেও প্রতি এপিসোডের সময়কাল অন্তত পাঁচ মিনিট কমানো যেত সহজেই। অথবা সহযোগী কাস্টদের চরিত্রায়ণে আরেকটু বেশি সময় দিলেও ক্ষতি ছিল না। 'স্লো বার্ন' পদটি আরো যুক্তিযুক্ত হত এতে।
তবে হতাশাজনক 'মরীচিকা' আর মাঝারি মানের সিন্ডিকেটের পর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিঃসন্দেহে পরিচালক হিসেবে শিহাব শাহীনের সেরা থ্রিলার মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন।
সম্প্রতি বিঞ্জ ওয়েব ফিল্ম মায়াশালিক-এও দুর্দান্ত কাজ দেখিয়েছেন তিনি। তবু মাইশেলফ স্বপনে তার সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল নিজেকে নতুন করে প্রমাণের। আর সেই চ্যালেঞ্জে বেশ ভালোভাবেই উতরে গেছেন তিনি। একাধারে প্রমাণ করেছেন যে তিনি এখন আর শুধু 'কিং অব রোমান্স'ই নন, এবং করোনাকালে মুক্তিপ্রাপ্ত থ্রিলার আগস্ট ১৪-ও কোনো ফ্লুক ছিল না।
শেষ করার আগে উল্লেখ করা প্রয়োজন কামরুল ইসলাম শুভর কথাও। চট্টগ্রাম ও ঢাকার নানা লোকেশনে ধারণকৃত এই সিরিজে চোখধাঁধানো সিনেমাটোগ্রাফি উপহার দিয়েছেন তিনি।
সব মিলিয়ে, দেশের ইতিহাসে প্রথম স্পিন-অফ সিরিজ হিসেবে দারুণ পদক্ষেপ মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন, মানের বিচারে যা পেছনে ফেলেছে তার পূর্বসূরি সিন্ডিকেটকেও।