দীর্ঘ বিরতির পর অফশোর ব্লকে অনুসন্ধানে আগ্রহী হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো
সাম্প্রতিক কয়েক মাসে বাংলাদেশে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক তেল উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ বেড়েছে। বিশেষ করে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন ও ভারতের মতো আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সুপারপাওয়ার দেশগুলোর প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখাচ্ছে বেশি।
দক্ষিণ কোরিয়ার পসকো ইন্টারন্যাশনাল, অস্ট্রেলিয়ার স্যান্টোস ও আজারবাইজানের সকারসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি এখানে কার্যক্রম বন্ধ করার বেশ কয়েক বছর পর ফের এসব প্রস্তাব পাচ্ছে বাংলাদেশ।
বর্তমানে বাংলাদেশে ২৬টি ওপেন অফশোর ও ২২টি অনশোর ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি অফশোর ব্লক অগভীর সমুদ্রে ও ১৫টি গভীর সমুদ্রে।
সরকার ওএনজিসি ভিদেশ ও অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেডের সঙ্গে দুটি অগভীর সমুদ্র ব্লকের জন্য (এসএস-০৪ ও এসএস-০৯) উৎপাদন বণ্টন চুক্তি (পিএসসি) অনুমোদন করেছে। কোম্পানি দুটি যৌথভাবে এলাকাগুলোতে অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
মোট অনশোর ব্লকগুলোর মধ্যে মাত্র চারটি ব্লক আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছে। মার্কিন তেল জায়ান্ট শেভরন তিনটি উপকূলীয় ব্লকে (১২, ১৩ ও ১৪) প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন করছে। আর সিঙ্গাপুরের ক্রিসএনার্জি কাজ করছে ব্লক-৯-এ।
এদিকে পেট্রোবাংলা একটি নতুন মডেল পিএসসির খসড়া তৈরি করেছে। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সেটির আইনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার চলছে। আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোকে স্থানীয় ক্ষেত্রে আকৃষ্ট করতে এ চুক্তির আওতায় বড় আউটপুট শেয়ার দেয়া হবে; বেশি দেওয়া হবে গ্যাসের দামও।
প্রস্তাবিত পিএসসিতে আইওসি-উৎপাদিত গ্যাসের ক্রয়মূল্য প্রতি হাজার ঘনফুটে (এমসিএফ) প্রায় ১০ ডলার বাড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যা বিদ্যমান পিএসসির হারের চেয়ে তিনগুণ বেশি। 'প্রফিট গ্যাসে' সরকারের হিস্যাও আগের পিএসসির ৫৫-৮০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪০-৭০ শতাংশ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোর প্রস্তাবকে বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক লক্ষণ হিসেবে দেখছেন। তবে একইসঙ্গে তারা সতর্ক করেছেন যে সরকারকে সতর্কতার সঙ্গে প্রস্তাবগুলো সামলাতে হবে।
দেশের জ্যেষ্ঠ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, 'আইওসির প্রস্তাবের পেছনে কোনো ভূ-রাজনৈতিক কারণ থাকতে পারে। তবে আমাদের উচিত তাদের প্রস্তাবকে স্থানীয় তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ইতিবাচক লক্ষণ হিসেবে নেওয়া, বিশেষ করে প্রস্তাবটা যখন এক্সনমোবিলের মতো বড় কোম্পানি থেকে আসে।
'এর আগে কোম্পানিগুলো গ্যাসের দাম নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় গ্যাসক্ষেত্র ছেড়ে চলে গেছে। এখন বাংলাদেশ যেহেতু আইওসিগুলোর লাভ বাড়িয়ে পিএসসিকে আকর্ষণীয় করছে, তাই অন্যান্য কোম্পানিও আগ্রহ দেখাচ্ছে। তাই এই প্রস্তাবগুলো গুরুত্বের দিয়ে আলোচনা করতে হবে।'
এর আগে গত ২৩ মার্চ পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার জানিয়েছিলেন, গভীর সমুদ্র ও অনশোর ব্লকগুলোর জন্য এক্সনমোবিলের প্রস্তাবের ভিত্তিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় পেট্রোবাংলার কাছ থেকে একটি প্রতিবেদন পেয়েছে। তিনি আরও জানান, মন্ত্রণালয় বর্তমানে প্রস্তাব ও প্রতিবেদন দুটোই বিশ্লেষণ করছে।
স্থলের পাশাপাশি সমুদ্রও চায় যুক্তরাষ্ট্র
নতুন ব্যবসায়িক পদক্ষেপ হিসেবে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল ও গ্যাস কোম্পানি এক্সনমোবিল কর্পোরেশন বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার সমস্ত উন্মুক্ত গভীর পানির অফশোর ব্লক ও কিছু অনশোর ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
একইসঙ্গে শেভরন কর্পোরেশন—যারা স্থানীয় ক্ষেত্র থেকে উৎপাদিত ৬০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহের জন্য তিনটি কূপ উন্নয়ন করছে—এখন সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার সুনেত্রা গ্যাসক্ষেত্রেও তাদের কাজের পরিধি বাড়াতে আগ্রহী।
মার্কিন বহুজাতিক জ্বালানি কর্পোরেশন শেভরনের সুবাদে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। স্থানীয় গ্যাসের সিংহভাগ উৎপাদনই করে শেভরন।
এছাড়া টেক্সাসভিত্তিক প্রাকৃতিক গ্যাস বিতরণ কোম্পানি এক্সেলারেট এনার্জি মহেশখালীতে দুটি ভাসমান স্টোরেজ ও রিগ্যাসিফিকেশন ফ্যাসিলিটির মাধ্যমে বাংলাদেশে এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন সেবা দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র পটুয়াখালীর পায়রাতেও আরেকটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য সরকারের কাছ থেকে নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে।
বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশের অংশে হাইড্রোকার্বন মজুতের তথ্য সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশ তার বহুল প্রত্যাশিত মাল্টি-ক্লায়েন্ট জরিপ শুরু করেছে, যা চলতি মে মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।
ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেছেন এক্সনমোবিল ও আইওসির অন্যান্য প্রস্তাবের উপর আলোচনা চলছে এবং তারা বাংলাদেশের শর্তাবলিতে সম্মত হলে চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে।
নিজের অবস্থান আরও শক্ত করতে চায় রাশিয়া
যুক্তরাষ্ট্র যেমন বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসায়িক সংযুক্তি বাড়াতে চায়, তেমনি রাশিয়াও অস্থিতিশীল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত লজিস্টিক ও আর্থিক সমস্যা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্ভাব্য বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার সুযোগ খুঁজছে।
চলতি বছরের ১৩ থেকে ১৫ মার্চ ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত রাশিয়া-বাংলাদেশ ইন্টারগভর্নমেন্টাল কমিশন অন ট্রেড, ইকোনমিক, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশনের (আইজিসি) চতুর্থ অধিবেশনে রাশিয়া বাংলাদেশের কাছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রপ্তানির প্রস্তাব দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রুশ প্রতিনিধিরা তেল ও তেলজাত পণ্য রপ্তানি, কয়লা শিল্পে সহযোগিতা এবং যৌথভাবে সবুজ শক্তি বিশেষ করে পারমাণবিক সৌরশক্তির উৎস গড়ে তোলার আগ্রহ দেখিয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে এ প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়।
বর্তমানে পারমাণবিক প্রযুক্তিতে আন্তর্জাতিকভাবে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান রাশিয়ান স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি কর্পোরেশন—রোসাটম পাবনায় বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
গাজপ্রম ইপি ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্টস বিভি-ও বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ করছে।
বাংলাদেশ বর্তমানে দৈনিক ৩,৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ) গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এখন স্থানীয় উৎস থেকে দৈনিক ২,২০০ এমএমসিএফ এবং আমদানি করা এলএনজি থেকে ৬০০ এমএমসিএফ গ্যাস পাওয়া যায়। ফলে বাংলাদেশ এখন গ্যাস সংকটে ভুগছে।
বাংলাদেশ কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করলেও এই প্রথম রাশিয়া সরকারি পর্যায়ে এদেশে এলএনজি রপ্তানির প্রস্তাব দিয়েছে।
পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে চীন ও ভারতের রশি টানাটানি
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ছাড়াও আঞ্চলিক শক্তিধর ভারত এবং চীনেরও বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ রয়েছে।
চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি) কয়লা খনন ও কয়লা বিদ্যুৎ উন্নয়নে নিযুক্ত রয়েছে। অন্যদিকে চায়না পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড কেমিক্যাল কর্পোরেশন (সিনোপেক) গ্যাস খাতে কাজ করছে।
এদিকে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ ও তরল রপ্তানিতে বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে প্রতিবেশী ভারতের উল্লেখযোগ্য হিস্যা রয়েছে।
সম্প্রতি এশিয়ার উভয় প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে বাপেক্স সূত্রে জানা গেছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের শাখা পেট্রোচায়না কোম্পানি লিমিটেড এবং ইন্ডিয়ান অ্যাডভেন্ট অয়েলফিল্ড সার্ভিসেস প্রাইভেট একই এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
এছাড়াও ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন লিমিটেড (আইওসিএল) ও এইচ-এনার্জি বাংলাদেশে আন্তঃসীমান্ত এলএনজি সরবরাহে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।