আরও কঠোর কর্মসূচির পরিকল্পনায় বিএনপি
সরকার পতনের আন্দোলনকে ধাপে ধাপে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার ধারাবাহিক কর্মসূচি নিয়েছে বিএনপি। দীর্ঘদিন ধরে চলমান যুগপৎ আন্দোলনকে ধাপে ধাপে কঠোর কর্মসূচির দিকে নিয়ে যাচ্ছে দলটি। তবে কর্মসূচির ব্যাপারে খুবই সতর্ক এবং কৌশলী এবার বিএনপি। বিএনপির কর্মসূচির সময়ে আওয়ামী লীগ উস্কানিমূলক পাল্টা কর্মসূচি দিলে আপাতত সেটা এড়িয়ে চলার নীতি নিয়েছে দলটি।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অথবা মানববন্ধন ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে আন্দোলনের গতি বাড়াতে চায় বিএনপি। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে দাবি আদায় না হলে পরে রোডমার্চ, লংমার্চ, অবস্থান ও ঘেরাওয়ের মতো কঠোর কর্মসূচিতে যেতে চায়। তবে সবগুলো কর্মসূচিতেই শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখার কৌশল দলটির পক্ষ থেকে।
সরকার পতনে চূড়ান্ত আন্দোলনে কী ধরণের কর্মসূচি দেয়া হবে তা নিয়ে এসব বৈঠকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। অনেকে হরতাল এবং অবরোধ কর্মসূচির কথা বলেছেন। আবার অনেকে ঢাকা ঘেরাও দিয়ে রাজপথ দখল করে বসে পড়ার কথা বলছেন। চূড়ান্তভাবে সচিবালয় ঘেরাও ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও হতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিচ্ছে দলটির নেতারা।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, 'বিএনপি ১০ দফা দাবি আদায়ের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে আমরা কর্মসূচির ধরন পরিবর্তন করব। যখন যে ধরনের কর্মসূচি প্রয়োজন, আলোচনা করে তাই করা হবে।'
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, 'আমরা ১০ দফা দাবি আদায় আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি তা চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আন্দোলন আরো বেগবান হবে। সরকারের আচরণের উপর নির্ভর করবে আন্দোলন কোন ধরনের হবে।'
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, 'নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আমাদের আন্দোলনের দাবি মেনে না নিলে আমরা চূড়ান্ত আন্দোলনের দিকে যাব। ধাপে ধাপে একটার পর একটা আন্দোলন আসবে। এই অবৈধ সরকার যাতে আর অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করতে না পারে সেজন্য জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করছি। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণ আন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকারের পতন ঘটাবো। এজন্য সর্বশেষ অবরোধ, হরতাল এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় কিংবা সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি হতে পারে। কোন আন্দোলন যে কখন হবে সেটা বলা যাচ্ছে না। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত রাস্তা আমাদের দখলে থাকবে এবং আন্দোলন চলবে।'
২০২২ সালের জুলাই থেকে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে রাজপথে লাগাতার আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। সরকারের অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে অনেক লোকের সমাগম নিয়ে বড় বড় বিভাগীয় সমাবেশ করে বিএনপি। কিন্ত ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় বাহ্যিকভাবে অনেকটা ব্যাকফুটে যায় দলটি। কিছুটা ছন্দপতন হয় চলমান আন্দোলনের।
সরকার পতনের চলমান এ আন্দোলনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এ পর্যন্ত ১৭ নেতাকর্মী নিহত ও অসংখ্য আহত এবং কারাগারেও যেতে হয়েছে বলে দাবি করছে বিএনপি।
সংবিধান অনুযায়ী, ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সে অনুযায়ী সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে ঘোষণা হতে পারে নির্বাচনের তফসিল। এছাড়া সরকারের জন্য সুবিধাজনক হলেও জুনে বাজেট পেশের পরপরই আগাম নির্বাচনে তফসিল ঘোষণাও করে দিতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে বিএনপির মধ্যে।
তাই তফসিলের আগের চার মাসের মধ্যেই আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে চায় টানা ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। সে লক্ষ্যে আগামী দু-তিন মাসে তৃণমূল থেকে আন্দোলনের ঢেউ তুলতে চায় তারা। তারপর ঢাকাসহ সারা দেশের রাজপথে চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিকল্পনা রয়েছে।
বিএনপির ঢাকা মহানগরের দায়িত্বশীল নেতারা জানান, আগামীতে ঢাকায় বড় কর্মসূচির ডাক আসবে। সে জন্য ইতোমধ্যে পদযাত্রার মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীদের ওয়ার্ম-আপ করানোও হয়েছে। এর আগে গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকায় ১৬টি স্পটে সমাবেশ করেছে বিএনপি। এবার চূড়ান্ত আন্দোলন থেকে পিছপা হওয়ার সুযোগ নেই। হাইকমান্ড থেকে মহানগরের নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে মাঠের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা চলছে। সে সঙ্গে আন্দোলন নিয়ে মতামত নেওয়া হচ্ছে। যারা নিষ্ক্রিয় তাদের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ঢাকার কর্মসূচিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কর্মসূচিতে ছাত্র-তরুণসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সুশীল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের প্রতিবাদী আওয়াজ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
বহিষ্কৃতদের দলে ফেরানোর আভাস
বিএনপিতে বহিষ্কৃত নেতাদেরও দলে ফেরানোর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বহিষ্কৃতদের মধ্যে কুমিল্লার সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু, খুলনার মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার প্রভৃতি নেতারা বহিষ্কৃত হয়েও দীর্ঘদিন ধরে দলের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছেন।
ইতোমধ্যে নজরুল ইসলাম মঞ্জু ঘোষণা দিয়েছেন দল না চাইলে তিনি সিটি করপোরেশন নির্বাচন করবেন না। বহিষ্কৃত হওয়ার পর দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে মূল্যায়ন না পেলেও কুমিল্লার মেয়র সাক্কু ও তৈমর আলম, নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে ইদানিং দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচিতেও দেখা যাচ্ছে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে দলের সর্বস্তরের বহিষ্কৃত নেতাদের দলে ফেরানোর আলাপ-আলোচনা চলছে, চলমান আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধি ও আগামী নির্বাচন সামনে রেখেই মূলত এ সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে।