১৫টি দেশের সাংবিধানিক রাজা চার্লস, কিন্তু কতদিন এ পদে থাকতে পারবেন আর?
ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লস বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশের রাজা হিসেবেও বিবেচিত হন। এ দেশগুলোকে একত্রে কমনওয়েলথ রিয়ালম বলা হয়। মোট ১৫টি দেশের রাজা তৃতীয় চার্লস, যদিও পদটা স্রেফ আলংকারিক। তবে এসব দেশের অনেকগুলোই এখন কমনওয়েলথ রিয়ালম থেকে বেরিয়ে এসে রিপাবলিক হতে চাচ্ছে। বিস্তারিত বিবিসি ও এবিসি নিউজ-এর প্রতিবেদনে।
সম্প্রতি কমনওয়েলথ রিয়ালমের দেশগুলোর জনমত জরিপ করেছেন যুক্তরাজ্যের কনজার্ভেটিভ পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান লর্ড আশক্রফট। সেখানে দেখা গেছে, প্রায় অর্ধেকের মতো দেশ সাংবিধানিক রাজতন্ত্র বাদ দেওয়ার পক্ষে।
এবিসি নিউজ-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২২ হাজার মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় ওই জরিপের জন্য। ছয়টি দেশ রাজতন্ত্র বাতিলের পক্ষে ভোট দেয়। এ দেশগুলো হলো অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জ্যামাইকা, দ্য বাহামাস, সলোমন আইল্যান্ড, এবং অ্যান্টিগুয়া ও বার্বুডা।
যুক্তরাজ্যের রাজতন্ত্রবিরোধী দল রিপাবলিক ইউকে-এর প্রধান নির্বাহী গ্রাহাম স্মিথ মনে করেন, গত বছর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর থেকে রাজতন্ত্র ক্রমশ ক্ষীয়মাণ হচ্ছে।
'তিনিই ছিলেন সাম্রাজ্য, সাম্রাজ্য তাকে কেন্দ্র করেই চলত,' এবিসি নিউজকে বলেন স্মিথ। 'চার্লসের পক্ষে রানির মতো হয়ে ওঠা কখনোই সম্ভব নয়। অনেক মানুষের কাছেই রাজতন্ত্র শেষ হয়ে গেছে রানির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে।'
নিজের ৭০ বছরের রাজত্বে রানি এলিজাবেথ কেবল দুইটি দেশ বাদে কমনওয়েলথের বাকিসব দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। অনেকে দেশে তিনি একাধিকবারও গিয়েছিলেন।
স্মিথের ধারণা, রাজতন্ত্র থেকে বিদায় নেওয়া পরবর্তী দেশ হতে যাচ্ছে জ্যামাইকা। তার মতে অস্ট্রেলিয়ারও সমূহ সম্ভাবনা আছে রাজতন্ত্র বাদ দিয়ে নিজেদের রিপাবলিক ঘোষণা করার।
অস্ট্রেলিয়া একটি বড় গণতান্ত্রিক দেশ। তাই তারা যদি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র বাতিল করে, তাহলে অন্য ছোট দেশসমূহও এটিকে অনুসরণ করবে বলে মন্তব্য করেন স্মিথ।
সাংবিধানিক রাজতন্ত্র বাদ দিয়ে রিপাবলিক রাষ্ট্র হওয়া নিয়ে নির্বাচিত তিনটি দেশের জনগণ কী ভাবছেন, তা জানিয়েছে বিবিসি।
অস্ট্রেলিয়া
শনিবার (৬ মে) রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেক। কিন্তু কমনওয়েলথ রিয়ালমের দেশ অস্ট্রেলিয়ায় এ নিয়ে বিশেষ কোনো উদযাপন দেখা যায়নি।
অভিষেকের সপ্তাহখানেক আগের অস্ট্রেলিয়ার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বিবিসি'র প্রতিবেদক জানিয়েছেন, দেশটির রাস্তাঘাটে রাজার অভিষেক উদযাপনের তেমন কোনো চিহ্ন নেই। অনেকেই অভিষেক কখন তাও জানেন না। এমনকি কেউ কেউ রাজার অভিষেক বিষয়টি কী সেটাও বলতে পারেননি।
গ্রাহাম নামক ৭৩ বছর বয়সী এক অস্ট্রেলিয়ান তো চার্লসের অভিষেক বিষয়ে সরাসরি বলেই দিয়েছেন, 'আমার বয়েই গেছে, এসব অপ্রাসঙ্গিক।'
শনিবার রাতে অবশ্য অস্ট্রেলিয়ায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা অভিষেককে কেন্দ্র করে আলো দিয়ে সাজানো হবে। কিন্তু দিনটি আয়োজনের আনুষ্ঠানিকতা সবমিলিয়ে স্বল্প আর দায়সারা।
অস্ট্রেলিয়ায় রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জনপ্রিয়তার ধারেকাছে নেই রাজা চার্লস। আর তার অভিষেকও এমন সময়ে ঘটছে যখন রিয়ালম থেকে বেরিয়ে রিপাবলিক হওয়ার দাবি দেশটিতে কয়েক দশকের মধ্যে সবেচেয়ে শক্তিশালী।
প্রায় ২৫ বছর আগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রথম গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়। সে ভোটে অবশ্য সাম্রাজ্যের অংশ থাকার পক্ষরাই জয়ী হন। এ মুহূর্তে নতুন করে আরেকবার গণভোট আয়োজনের চাপ তৈরি হয়েছে দেশটির সরকারের ওপর।
এর আগে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ বলেছেন, রিপাবলিকে পরিণত হওয়া 'অনিবার্য'। গত বছর দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রিপাবলিকের জন্য একজন জুনিয়র মন্ত্রী নিয়োগ দেন তিনি।
অন্যদিকে প্রতিবেশি নিউজিল্যান্ডেও একই দৃশ্য — প্রধানমন্ত্রী ক্রিস হিপকিনস এ সপ্তাহে বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন তার দেশ একদিন সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে রিপাবলিক হবে।
অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশ সম্রাটের পদটি স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা। দেশটির মানুষ মনে করেন, অনেক আগেই যুক্তরাজ্যের ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজের আলাদা পরিচয় তৈরি করে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া।
মনিকা জানুলেভিকিট নামক এক তরুণী বলেন, 'এখানে একটা ইংরেজ রাজা থাকার ব্যাপারটা স্রেফ অদ্ভুত মনে হয়।'
তবে অস্ট্রেলিয়াকে রিপাবলিকে পরিণত হতে কমপক্ষে আরও কয়েক বছর লাগবে।
সাম্প্রতিক বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, গণভোটে রিপাবলিকের পক্ষে পর্যাপ্ত ভোটের জন্য এখনো যথেষ্ট জনমত তৈরি হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার জনগণের বড় একটা অংশকে রিপাবলিকের পক্ষে হ্যাঁ-ভোট দিতে হবে এবং দেশটির ছয়টি রাজ্যের কমপক্ষে চারটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থনের প্রয়োজন হবে।
কানাডা
কানাডায় রাজা চার্লসকে নিয়ে বেশিরভাগ মানুষের অনুভূতিকে এক কথা প্রকাশ করতে গেলে বলতে হবে: 'উদাসীন'।
অস্ট্রেলিয়ার মতো কানাডাতেও রাজা চার্লসকে নিয়ে মানুষের তেমন আগ্রহ নেই। যদিও দেশটিতে রানি এলিজাবেথ মানুষের স্নেহভাজন ছিলেন।
বিভিন্ন জনমত জরিপে দেখা গেছে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে নিজেদের দূরত্ব বাড়াতে ক্রমশ বেশি আগ্রহী হচ্ছেন কানাডিয়ানরা।
গত এপ্রিলে এক জরিপে উঠে এসেছে, কানাডার অর্ধেকের বেশি মানুষ আগামী প্রজন্মের জন্য সাংবিধানিক রাজতন্ত্র চান না।
বিবিসি'র প্রতিবেদককে প্রতি পাঁচজনের দুইজন বলেছেন, চার্লসের অভিষেক নিয়ে তারা একেবারেই আগ্রহী নন।
কানাডার অন্য অঞ্চলগুলোর তুলনায় কুইবেকে সাংবিধানিক ব্রিটিশ রাজতন্ত্র ব্যবস্থাকে বেশি নেতিবাচক হিসেবে দেখা হয়। গত ডিসেম্বর মাসে আইনপ্রণেতাদের জন্য ব্রিটিশ রাজার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের বিষয়টি ঐচ্ছিক হিসেবে রেখে একটি আইন পাস করে কুইবেক।
বারবাডোস, জ্যমাইকা, বা অস্ট্রেলিয়ায় রাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা অতীতে হয়েছে বা এখন চলমান রয়েছে। তবে কানাডা এখনো সে পর্যায়ে যায়নি।
বর্তমান রাজতন্ত্র ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার কাজটা কানাডার জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কঠিন হবে। কারণ এর জন্য দরকার হবে হাউজ অভ কমন্স ও পার্লামেন্টের সিনেটের অনুমতি এবং দেশটির ১০টি প্রদেশের সর্বসম্মত মতৈক্য।
সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস
ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ইংরেজরা প্রথম বসতি স্থাপন করেছিল সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসে। দ্বৈত-দ্বীপের এ দেশটি আটলান্টিক মহাসাগর ও ক্যারিবিয়ান সাগরের মাঝখানে অবস্থিত।
দেশটির জাতীয় খেলা ক্রিকেট — যুক্তরাজ্যের আরও অনেক প্রভাবের শক্তিশালী নিদর্শন রয়েছে এ দ্বীপরাষ্ট্রে। তবে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর সাংবিধানিক রাজতন্ত্র থেকে বের হওয়া নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে এখানে।
রাজা চার্লসকে তাদের দেশের প্রধান হিসেবে কীভাবে দেখেন — এমনটা জানতে চাইলে বিবিসি'র কাছে শার্লিন মার্টিন বলেন, 'চীনা ও তাইওয়ানিজরা ইংল্যান্ডের চেয়েও বেশি আমাদের খেয়াল রাখে।'
স্থানীয় পানশালার ব্যবস্থাপক জুলিয়ান মর্টনের কাছে বিষয়টি জাতীয় গৌরবের ব্যাপার। 'রিপাবলিক হলে বাকি বিশ্ব জানবে, আমরা আমাদের নিজের বিষয়াদি নিজেরাই সামলাতে পারি,' বলেন তিনি।
তবে জুলিয়ানের বন্ধু ক্রিস্টোফার রবার্টস বলেন, তার দেশ করোনাভাইরাস সামলে মাত্র উঠে দাঁড়াচ্ছে। এ মুহূর্তে রিপাবলিক হওয়া-না-হওয়ার ব্যাপারটি বিশেষ মাথাব্যথার নয়।
যেহেতু ক্যারিবিয়ানের অন্য অনেক দেশের তুলনায় সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস তুলনামূলকভাবে 'তরুণ স্বাধীন রাষ্ট্র', তাই সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে পরিবর্তন আনতে কিছুটা সময় লাগবে বলে মনে করেন তিনি।
দেশটির রিপাবলিক হওয়ার সিদ্ধান্তের জন্য গণভোট আয়োজনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে।