রবীন্দ্রসঙ্গীতের পাঁচ অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক জীবনে অন্তত ২২৩২টি গান লিখেছেন। গীতবিতানে সংকলিত হয়েছে গানগুলো। 'যাহা দিলাম তাহা উড়াড় করিয়াই দিলাম। এখন ফিরিয়া তাকাতে গেলে দুঃখ পাইতে হইবে'- এই জীবনদর্শনেই বিশ্বাস ছিল তার। তাই আজীবন জ্ঞান আর সৃষ্টি ভাণ্ডার দিয়ে সমগ্র মানবজাতিকে সমৃদ্ধ করেছেন।
উপনিষদ,সংস্কৃত সাহিত্য, বৈষ্ণব সাহিত্য ও বাউল দর্শনের প্রভাব রয়েছে তার গানের বাণীতে। সুরে রয়েছে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পা, তরানা, ভজন ইত্যাদি ধারার সুর। একইসঙ্গে বাংলার লোকসংগীত, কীর্তন, রামপ্রসাদী, পাশ্চাত্য ধ্রুপদি সংগীত ও পাশ্চাত্য লোকগীতির চিরচেনা সুরও দারুণভাবে মিশে আছে তার গানে।
রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা করে কিংবদন্তি হয়ে ওঠা শিল্পীর সংখ্যাও কম নয়। তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন ভারতীয় শিল্পীর কথা জানব হিন্দুস্তান টাইমসের সূত্র ধরে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
বাঙালি সঙ্গীতপিপাসু মানুষমাত্রই এক নামের তাকে চেনে সবাই। আধুনিক বাংলা গান, চলচ্চিত্রের গান যেমন গেয়েছেন, তেমনই রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা করে গেছেন আজীবন এই সুরেলা কণ্ঠের জাদুকরি শিল্পী। বেশ কিছু চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তিনি।
চলচ্চিত্রের জন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে প্রথমবার রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড হয় ১৯৪২ সালে। 'অপরাধ' ছবির 'ওই যে ঝড়ের মেঘের কোলে' ছিল সেই গান। অন্যদিকে তার কণ্ঠে প্রথম জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত,'পথের শেষ কোথায়'। তার প্রথম বেসিক রেকর্ডের রবীন্দ্রসঙ্গীত মুক্তি পায় ১৯৪৪ সালে। সেই রেকর্ডে ছিল 'কেন পান্থ এ চঞ্চলতা' ও 'আমার আর হবে না দেরি' গান দুটি।
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়
রবীন্দ্রসঙ্গীতের যথার্থ সুর ও ঘরানাকে গায়কির মধ্য দিয়ে আজীবন তুলে ধরার জন্য সবিশেষ খ্যাত এই শিল্পী। তার জীবনের বেশির ভাগ দিনগুলোই কেটেছে কবিগুরু প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনে। স্বয়ং কবিগুরু তার নাম অণিমা থেকে কণিকা রেখেছিলেন।
১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথের কলকাতার ছায়া সিনেমাহলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরের বছর তার প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত হয় হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি থেকে। সেখানে গান ছিল 'মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে' এবং 'না না না ডাকব না, ডাকব না'। এই গান শুনে কবিগুরু প্রশংসা করেছিলেন তার।
দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়
আজীবন রবীন্দ্র সাধনায় কাটিয়েছেন তিনি। তার রেকর্ড করা ১৫০০ গানের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত আট শতাধিক। এর মধ্যে প্রথম রেকর্ড করা গান, 'তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী'। সেটি ১৯৫১ সালের ঘটনা।
সুচিত্রা মিত্র
তিনি শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক প্রথিতযশা শিল্পীই নন, বিশেষজ্ঞও। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগের প্রধান ছিলেন দীর্ঘকাল। শৈশবে পঙ্কজকুমার মল্লিকের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে আকৃষ্ট হন। পরবর্তী সময়ে কবিগুরুর সাহচর্য পেয়েছিলেন।
'মরণেরে তুঁ হু মম শ্যাম সমান' ও 'হৃদয়ের একুল ওকুল দু'কুল ভেসে যায়'- এ দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে ১৯৪৫ সালে তার প্রথম রেকর্ড বের হয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তার দৃপ্ত কণ্ঠে গাওয়া 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি' মুক্তিযোদ্ধাদের দারুণ প্রেরণা জুগিয়েছিল।
চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়
রবীন্দ্রসঙ্গীতের সর্বকালের সেরা শিল্পীদের মধ্যে তার নাম সব সময় একদম প্রথম সারিতে থাকে। দেড় শতাধিক রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড করেছেন তিনি।
তার গানের স্টাইল ছিল অনন্য। তার কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতে রাবীন্দ্রিক ভাব, গায়কী, স্পষ্ট উচ্চারণ এবং স্বরলিপির নিখুঁত ব্যবহার তাকে কিংবদন্তিতে পরিণত করেছে।