বাৎসরিক বিড়াল মারা উৎসব: আমাদের হৃদয় থেকে কি দয়া ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে?
শুক্রবার সকালে ঘুম ভাঙলো সাংঘাতিক খারাপ খবর দিয়ে, আমাদের বিড়াল মাস্কাকে পাওয়া যাচ্ছে না। একমাস বয়সী মাস্কাকে প্রায় মৃৎবত অবস্থায় রাস্তা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়েছিল। এরপর গত ৩/৪ বছর ধরে এই বাসায় সে দিব্যি নিজের জায়গা করে নিয়েছে। খুব একটা মিশুক স্বভাবের না হলেও সবাই তাকে ভালবাসে। ওকে আমরা একা ছাড়িনা কোথাও। সেই মাস্কা যখন নাই হয়ে গেল, মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। কাজকর্ম, রান্নাবান্না বাদ দিয়ে সবাই মাস্কাকেই খুঁজতে শুরু করলো। কারণ ও আমাদের পরিবারের একজন সদস্য।
ঠিক সেরকম একটি বিপর্যস্ত অবস্থায় খবর পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে 'বাৎসরিক বিড়াল মারা উৎসব' শুরু হয়েছে। হোমফিড খুলতেই চোখে এলো সেই হলের জানালার কার্নিশে মেরে রাখা মৃত বিড়ালদের ছবি। রাগে, শোকে, দুঃখে প্রচণ্ড রকম হতাশ হয়ে পড়লাম। একদিকে আমার পরিবারের বিড়ালটি হারিয়ে গেছে, অন্যদিকে বিড়ালগুলো মেরে ফেলে রেখেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মানুষরা। যাক আমাদের বিড়ালটি দুপুর নাগাদ ফিরে এলো।
পরেরদিন আবার ক্যাম্পাসে একটি হলের পাশে ঘুরে বেড়ানো সদ্য জন্মানো চারটি বিড়ালছানার গলাকাটা ছবি ফেসবুকে দেখে মনে হলো, যেন আমার সন্তানদের কেউ হত্যা করে ফেলে রেখেছে। ঐ একই দিনে খবরে দেখলাম, একটি মৃত নবজাতককে কেউ বুয়েটের ডাস্টবিনে ফেলে রেখে গিয়েছে। দুটো ঘটনাই ঘটেছে ক্যাম্পাসে এবং দুটিতেই সন্তানদের হত্যা করা হয়েছে।
ছাত্ররাই জানিয়েছে সন্ধ্যায় বিড়ালছানাগুলো মনের আনন্দে ক্যাম্পাসে ঘুরছিল, আর রাতেই তাদের গলায় ছুরি চালানো হলো। এই ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। তারাই বিড়াল ছানাগুলোকে গলাকাটা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। তারাই সেগুলোর ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেন। "সকালে আমরা গিয়ে দেখতে পাই, কাক এগুলোকে টেনে-হিঁচড়ে খাচ্ছে আর মা বিড়ালটা অস্থির হয়ে চারপাশে ঘুরছে।"
একজন ছাত্র জানিয়েছেন, "বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় টিউশনে যাওয়ার পথে হলের গার্ডেনে বাচ্চাগুলোকে দেখে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বাচ্চাগুলোকে এডোপশনের জন্য কোনো গ্রুপে পোস্ট দিব। ব্যস্ততার কারণে পোস্ট দিতে পারিনি।আজকে দেখি বাচ্চাগুলোকে মেরে ফেলেছে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে পোস্ট দিয়ে নিরাপদ জায়গায় রেখে আসলে এমন হতো না।"
কোন কারণে নগরে বা নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় যদি কুকুর-বিড়ালের সংখ্যা বেড়ে যায়, তাদের নিয়ন্ত্রণ করার বিভিন্ন উপায় আছে। জবাই দেয়ার মতো মারাত্মক অপরাধ করতে হবে কেন? কেন এতোটা নৃশংস হতে হবে? যে নবজাতকটিকে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হয়েছে, তাকেও তো কেউ না কেউ এ পৃথিবীতে এনেছে, সেই শিশুটিকে কেন মেরে ডাস্টবিনে ফেলে রাখতে হলো? আর দুটো দিন পড়ে থাকলে হয়তো বিড়ালের বাচ্চাগুলোর মতো তাকেও কুকুর, শকুন আর কাক টানাটানি করে খেতো। এখানে যারা মানুষের সন্তানকে হত্যা করেছে এবং যারা বিড়ালছানা হত্যা করেছে, তারা সবাই হত্যাকারী।
২০২২ সালে যখন নীল মাছরাঙা পাখির দ্বিখন্ডিত দেহ ও তার ডিমগুলোর ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল, তখনো নিজেকেই অপরাধী মনে হয়েছিল। কারণ আমারই মতো একজন মানুষের জন্য ছোট্ট মা পাখিটি বহু চেষ্টা করেও তার অনাগত সন্তানদের বাঁচাতে পারেনি। পাখিটির কী দোষ ছিল আমি জানি না। খবরে দেখলাম সেই হত্যাকারী লোকটা মাছরাঙ্গা পাখিটির বাসায় হামলা চালিয়ে মা পাখিটির মাথা ছিঁড়ে আলাদা করে এবং সেটা ডিমগুলোর পাশে রেখে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করেছে। প্রমাণিত হলো মানুষই পারে কোন কারণ ছাড়া তার নির্মম চেহারাটা প্রকাশ করতে।
প্রায় একই সময়ে ঢাকা কলেজের ভেতরে একটি কুকুরকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গিয়েছিল শিক্ষার্থী ও স্থানীয় দোকানদারদের বিরুদ্ধে। কলেজের শিক্ষার্থী ও কর্মচারীকে কামড় দেওয়ার অভিযোগ এনে কুকুরটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় বলে জানা গেছে। এই খবরটা দেখে কেউ কেউ দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, কুকুরটিকে পিটিয়ে না মেরে সিটি কর্পোরেশনকে খবর দিলে ওরা এসে নিয়ে যেতো বা পশু সংরক্ষক কোন গ্রুপকে খবর দিলেও ওরা একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করতো।
কিন্তু অধিকাংশ মানুষই মনে করেন ছাত্র-দোকানদাররা কুকুরটিকে পিটিয়ে মেরে বেশ করেছে। অনেকে বলেছেন যেমন কর্ম, তেমন ফল। কুকুর কামড়ালে কি আদর করবে তাকে? অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষই কুকুর হত্যার পক্ষে। যারা পিটিয়ে পশুপাখি হত্যার পক্ষে তাদের মনে রাখা উচিৎ মানুষ কিন্তু পশুর চেয়ে অনেক বেশি হিংস্র হয়ে উঠতে পারে কোন কারণ ছাড়াই।
দেশ ও সমাজের জন্য জবাই করে হত্যা করা ও পিটিয়ে মারার ট্রেন্ডটা খুব খারাপ। আজ আমরা বিড়াল ও বিড়ালের বাচ্চা বা কুকুর মানুষের ক্ষতি করেছে বলে, পিটিয়ে মারছি বা জবাই করছি। ঠিক এই কাজটা কিন্তু মানুষের সাথেও করা হয় সবসময়। এরকম অনেক উদাহরণ আছে এই দেশে, এই সমাজে। নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি, ঢাকা কলেজের সামনে ছাত্রদের একাংশের সাথে দোকানদারদের সংঘর্ষের সময় একজন কুরিয়ার বয়কে নৃশংসভাবে পিটিয়ে মারা হয়েছিল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ কেন কোন কারণ ছাড়াই পশুপাখি হত্যা করে? করে শক্তিহীনের উপর প্রতাপ দেখানোর জন্য, দুর্বলকে নিপীড়ন করার জন্য, বিকৃত আনন্দলাভের জন্য এবং একধরণের মানসিক অসুস্থতা থেকে। যে তরুণরা টিলার উপরে আশ্রয় নেয়া শিয়াল, বাঘডাসকে মেরেছিল, যারা বন্যার সময় ঘরে আশ্রয় নেয়া হরিণটিকে খেয়ে ফেলেছিল, যারা গন্ধগোকুল মাকে মেরে ফেলেছিল, যারা পথের কুকুরের হাত-পা ভেঙে দিয়েছিল, বিড়ালকে দড়িতে ঝুলিয়ে ফাঁসি দিয়েছিল, আহত শামুকখোল পাখিদের রান্না করে খেয়ে ফেলেছিল এবং বিষ খাইয়ে মাছ, বানর ও পাখি হত্যা করেছিল, এরা সবাই খুনি। আর এই খুনিদের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বিড়াল ও বিড়াল ছানাদের জবাই করেছে যারা এবং সন্তান জন্ম দিয়ে যারা নবজাতককে বুয়েটের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে, তাদের কোন অমিল নেই। এরা সবাই সমান অপরাধী। আজকে এরা বিনা প্রয়োজনে পশুপাখি খুন করছে, কালকে মানুষ খুন করবে। যেমনভাবে খুন করেছে আবরার, তসলিমা রেনু, বিশ্বজিৎ দাস, দীপন, অভিজিৎ রায় ও নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়সহ আরো অনেককে।
পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা একধরণের মানসিক বিকৃতি বা অসুস্থতা। সৃষ্টির সেরা হয়েও একমাত্র মানুষই পারে অপ্রয়োজনে বা তুচ্ছ কারণে ভয়ংকরভাবে মানুষ ও পশুপাখিকে হত্যা করতে, আর কোন জীব তা পারে না। মানুষের প্রতি মানুষের সহিংসতার সূত্রপাত হয় পশুপাখির প্রতি তার বা তাদের নির্দয় আচরণ করা থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধ বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তারা অপরাধীর ব্যাকগ্রাউন্ড পরীক্ষা করে দেখেছেন যে এদের অনেকেরই 'অ্যানিমেল অ্যাবিউজ' করার অতীত আছে। শিশু মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, যদি কারো ছোটবেলা থেকে প্রাণীদের ওপর নির্যাতন করার প্রবণতা থাকে, তাহলে বাবা-মা ও পরিবারের উচিৎ এই বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দেয়া। যদি এই প্রসঙ্গে শিশুকে সাবধান না করা হয়, তাহলে এরা বড় হয়ে মানুষের প্রতিও অমানবিক আচরণ করতে কুণ্ঠিত হবে না।
এমন কিছু ঘটনার কথা খবরে এসেছিল, যেগুলো দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় বাংলাদেশের মানুষ কোন কারণ ছাড়াই পশুপাখি হত্যা করতে পারঙ্গম। শ্রীমঙ্গলে ধানক্ষেত থেকে আহত অবস্থায় যে মেছোবাঘটিকে উদ্ধার করা হয়েছিল, তার কোমরে কেউ লাঠি দিয়ে আঘাত করেছিল। সীমান্ত দিয়ে নদী ও জঙ্গল পার হয়ে একটু খাবারের খোঁজে বাংলাদেশে যে দুই-চারটি নীলগাই এসেছিল, তাদের প্রায় প্রতিটিকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। ফেনীর সোনাগাজীতে গভীর রাতে কৃষকের একটি মা গাভী চুরি করে চামড়াযুক্ত গাভীর মাথা গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা। এরকম আরো অনেক বর্বর ঘটনার কথা খবর হয়ে আসে।
রাজবাড়ীতে একটি ঘোড়ার চার পা বেঁধে পায়ুপথে ও মূত্রনালিতে বাঁশের লাঠি ঢুকিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। শত্রুতা ছিলো ঘোড়ার মালিকের সঙ্গে, কিন্তু মরতে হলো ঘোড়াটিকে। একইভাবে হত্যা করা হয়েছিল বগুড়ার কাহালু এবিসি টাইলস কারখানায় রাসেলকে ও রুবেলকে। খুলনায় শিশু রাকিব এবং নারায়ণগঞ্জে শিশু সাগর বর্মণকে একইভাবে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।
পশুপাখি, গাছপালা মানুষের জীবনের সাথে জড়িত। আমরা অনেকেই জীব জগতকে ভালবাসতে শিখিনি। আমাদের সমাজে "জীবে দয়া করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর" এই বাণীর কোন মূল্য নেই। মানুষ ও পশুপাখির প্রতি দয়া দেখানোর কথা খুব গুরুত্ব দিয়ে শেখানোও হয় না।
প্রতিটি ধর্মেই পশুপাখির সাথে ভালো আচরণের কথা বলা হয়েছে। অনেকেই বলেন যে ইসলামে কুকুরকে শত্রু হিসেবে দেখা হয়েছে এবং এই যুক্তিতেই কুকুরের উপর নির্যাতন করা হয়। কিন্তু পবিত্র কোরআন ও হাদীস শরীফের কোথাও কুকুর বা অন্য কোন জীব হত্যার ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়নি।
পবিত্র হাদীসে আছে, আল্লাহর রাসুল (স:) বলেন, ''এক ব্যক্তি একটি কুয়ার নিকটবর্তী হয়ে তাতে অবতরণ করে পানি পান করলেন। অতঃপর উঠে দেখলেন, কুয়ার পাশে একটি কুকুর (পিপাসায়) জিহ্বা বের করে হাঁপাচ্ছে। তার প্রতি লোকটির দয়া হল। সে তার পায়ের একটি (চর্মনির্মিত) মোজা খুলে (কুয়াতে নেমে তাতে পানি ভরে এনে) কুকুরটিকে পান করালেন। ফলে আল্লাহ তার এই কাজের প্রতিদান স্বরূপ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করালেন।''
লোকেরা বলল, 'হে আল্লাহর রসূল! জীবজন্তুর প্রতি দয়া প্রদর্শনেও কি আমাদের সওয়াব আছে? তিনি বললেন, ''প্রত্যেক সজীব প্রাণবিশিষ্ট জীবের (প্রতি দয়া প্রদর্শনে) সওয়াব বিদ্যমান।'' তিনি বলেন, ''দুর্ভাগা ছাড়া অন্য কারো (হৃদয়) থেকে দয়া, ছিনিয়ে নেওয়া হয় না।''
একজন মানুষকে হত্যা করলে বা নৃশংস আচরণ করলে, তার যে কষ্ট হয়, পশুপাখির ক্ষেত্রেও তাই হয়। শুধু তারা ভাষাহীন বলে নূন্যতম প্রতিবাদটাও করতে পারে না। দেশে নৃশংসভাবে মানুষ হত্যা, নিপীড়ন, অত্যাচার, অবিচার যে হারে বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে প্রাণীকুলের প্রতিও নিষ্ঠুরতা। এসব দেখে দেখে মনে হচ্ছে, তবে আমরাই কি সেই দুর্ভাগা ও অপরাধী যাদের হৃদয় থেকে দয়া ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে? দয়াহীন ও ভালবাসাহীন মানুষ পৃথিবীর জন্য অভিশাপ।
- লেখক: যোগাযোগকর্মী
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।