ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর রেললাইন উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে ২৯৪%
ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েল রেল লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে দ্বিতীয় ডুয়েল গেজ লাইন নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ২৯৪ শতাংশ বাড়ছে।
একইসঙ্গে, প্রকল্পের মেয়াদ আরও ৫ বছর বাড়িয়ে ২০২৭ সালে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। যদিও এই প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের জুলাইয়ে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
মঙ্গলবার (৬ জুন) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটির দ্বিতীয় সংশোধিত প্রস্তাব উপস্থাপন করা হতে পারে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন সূত্র।
রাজধানীর ঢাকার সঙ্গে দ্রুত, অধিকতর নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দপূর্ণ বেশি সংখ্যক যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেন চালু করতে ২০১২ সালের জুলাইয়ে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয়।
শুরুতে এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮৪৮.৬০ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রথম সংশোধিত প্রস্তাবে ব্যয় বাড়িয়ে ১,১০৬.৮০ কোটি টাকা করা হয়। নতুন প্রস্তাবে প্রকল্পের ব্যয় আরও ২,২৩৫.৭৫ টাকা বাড়িয়ে ৩,৩৪৩.৫৫ কোটি টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছে রেলওয়ে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প নেওয়া, পরিকল্পিতভাবে প্রকল্পের নকশা প্রণয়ন না করায় বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসে বিভিন্ন অঙ্গের পরিবর্তন করতে হচ্ছে। এতে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে।
তুরাগ নদীতে ৪২ নং ব্রিজের ওপর আগে ডাবল ট্র্যাক নির্মাণের প্রস্তাব ছিল। নতুন প্রস্তাবে ৪টি ট্র্যাকের ব্রিজ করা হয়েছে। এতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে। এছাড়া, টঙ্গী সেতুর (৪২ নং ব্রিজ) হাইট ক্লিয়ারেন্স নূন্যতম ২ মিটার বৃদ্ধি করতে হচ্ছে। বর্তমান ৪২ নং টঙ্গী ব্রিজের ক্লিয়ারেন্স রয়েছে ৩.৫ মিটার।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটি) চাহিদা অনুযায়ী টঙ্গী সেতুর (৪২ নং সেতু) হাইট ক্লিয়ারেন্স ন্যূনতম ২ মিটার (৬.৫৬ ফুট) বৃদ্ধি করতে হচ্ছে।
এছাড়া, রেল ট্রাকের কিছু অংশে আগে ৪১ কেজি (৯০ পাউন্ড) পাউন্ডের রেল স্থাপনের কথা ছিল। এখন ৬০ কেজি রেল স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ কারণেও প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে।
প্রকল্পের আওতায় লুপলাইনসহ মোট ১৮৫.৭২ কিলোমিটার রেললাইন ৬০ কেজি রেলের মাধ্যমে নির্মাণ করা হবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এসএম সলিমুল্লাহ বাহার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এই রেল রুটটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ রেললাইন। প্রতিনিয়ত এর চাপ বাড়ছে। এ কারণে টঙ্গী সেতুর ডাবল ট্র্যাকের পরিবর্তে ৪টি ট্র্যাকের ব্রিজ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।"
"এই রেলপথ নির্মাণের পর পরই এই সেকশনে আন্তঃদেশীয় ভারী, দ্রুতগতি সম্পন্ন ও দীর্ঘ লোকমোটিভ বিপুল সংখ্যায় চলাচল করবে। এসব ভারী ও দ্রুতগতির লোকোমোটিরের জন্য এখনই ৬০ কেজি রেল ব্যবহার করে নির্মাণ কাজ করা জরুরি," যোগ করেন তিনি।
বিলম্বের কারণ ও বাস্তবায়ন কাজ শেষের নতুন সময়সীমা
রেলওয়ের একাধিক সূত্র জানায়, প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণে ব্যয় বেড়েছে।
২০১২ সালে জুলাই মাসে শুরু হওয়া এই প্রকল্প তিন বছরে শেষ করার কথা থাকলেও পরবর্তীতে পরামর্শক নিয়োগ, নকশা প্রণয়ন, বিস্তারিত ক্রয় পদ্ধতি এবং দরপত্র আহ্বান করতেই লেগে গেছে আরও ৫ বছর। এতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বারবার অনুমোদন নিতে হয়েছে বলে এতে সময়ক্ষেপণ হয়েছে।
রেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পে ভারতী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সময়মতো প্রকল্প সাইটে মালামাল, ফিটিংস, পাথর ও স্লিপার সরবরহ করেনি। পরে কোভিডের অজুহাতে ভারতীয় ঠিকাদার প্রকল্প সাইটে অনুপস্থিত ছিল। এসব কারণে বাস্তবায়ন কাজ বিলম্ব হয়েছে।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিপিপি প্রকল্প চলমান থাকায় ঢাকা বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর স্টেশন পর্যন্ত রেললাইন রেলওয়েকে হস্তান্তর না করার কারণেও বাস্তবায়ন কাজ বিলম্ব হচ্ছে বলে রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে।
সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের জুলাইতে প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার কথা ছিল। নতুন প্রস্তাবে প্রকল্পটির মেয়াদ ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা-টঙ্গী-জয়দেবপুর গুরুত্বপূর্ণ সেকশনটি রাজধানী ঢাকাকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। বর্তমানে ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে ২টি ডুয়েল গেজ লাইন এবং টঙ্গী জয়দেবপুর সেটশনে ১টি ডুয়েল গেজ লাইন রয়েছে। চাহিদা থাকার পরও এ সেকশনে অতিরিক্ত ট্রেন পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না।
বর্তমানে ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে ১১২টি এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ৪৪টি ট্রেন চলাচল করছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে ২৫০টি এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ৯০টি ট্রেন চলাচল করতে পারবে।
অতিরিক্ত ৬৬ মিলিয়ন ঋণ দেবে ভারত
দ্বিতীয় সংশোধিত প্রস্তাবে মোট ব্যয়ে ৮৩ শতাংশ দেবে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক। ফলে দ্বিতীয় সংশোধিত প্রস্তাব অনুযায়ী, ভারতীয় ঋণ বেড়ে হবে ২,৩৮০.৫০ কোটি টাকা। এর আগে, এই প্রকল্পে ভারতের ৯০২.৬৩ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া কথা ছিল।
রেলওয়ে ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনীর জন্য ৬৬ মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত ঋণ অনুমোদনে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের কাছ প্রস্তাব পাঠানো হয় ২০২২ সালের অক্টোবরে। চলতি ২০২৩ সালের মার্চে অতিরিক্ত অর্থায়নে সম্মতি জানায় ভারত।
প্রকল্পের আতওায় দুটি মেজর সেতু এবং ২২টি মাইনর সেতু/কালভার্ট নির্মাণ করা হবে। তেজগাও, বনানী, টঙ্গী ও শীরাশ্রম স্টেশন ভবন পুননির্মাণ এবং ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন ভবন ভার্টিকালি সম্প্রসারণ করা হবে। টেলিকমিউনিকেশনসহ ৭টি স্টেশনে কম্পিউটর বেইজড ইন্টারলকিং (সিবিআই) সিগন্যালিং সিস্টেম স্থাপন করা হবে। এছাড়া, ৩৭টি লেভেল ক্রসিং গেইটে সিগন্যাল ওয়ার্নিং সিস্টেম স্থাপন করা হবে।
রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিল পর্যন্ত এই প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৬৮.৭৫ শতাংশ। এই সময়ে মোট ব্যয় হয়েছে ৮১৭.৫৫ কোটি টাকা।