লিপিঘর: বাংলা ফন্টের বৃহত্তম ফাউন্ড্রির আদ্যোপান্ত
২০১৮ সালের কথা। একটি ফেসবুক গ্রুপে পরিচয় হয় পশ্চিমবঙ্গের নীলাদ্রি শেখর বালা ও বাংলাদেশের নুরুল আলম আদরের। অল্পদিনের মাঝেই দুই তরুণ আবিষ্কার করেন, তাদের দুজনের আগ্রহের বিষয়ই এক—বাংলা ফন্ট।
এ বিষয়ে তারা খোঁজখবর শুরু করেন। শেষতক দুজনে মিলে গড়ে ফেলেন একটি বাংলা ফন্ট তৈরির প্রতিষ্ঠান। উদ্দেশ্য, বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীদের জন্য চমৎকার সব মনোমুগ্ধকর নতুন নতুন ফন্ট বানানো। তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হলো- লিপিঘর।
এ বিষয়ে লিপিঘর প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলিনুর ইসলাম বলেন, 'তারা [দুই প্রতিষ্ঠাতা] দেখলেন ইন্টারনেটে হাজার হাজার ইংরেজি ফন্ট আছে। কিন্তু বাংলা ফন্টের বেলায় দেখা গেল খুব বেশি বৈচিত্র্যময় বাংলা ফন্ট নেই। এ কারণে তারা এই চ্যালেঞ্জটা নিয়েছেন।'
গত পাঁচ বছরে লিপিঘর বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীদের ২২১টি বাংলা ফন্ট উপহার দিয়েছে। এসব ফন্টের অধিকাংশই ফ্রিতে ডাউনলোড করা যায়। গ্রাহকদের জন্য তারা দামি ফন্টও বানায়। প্রতিষ্ঠানটি চারটি কিবোর্ড লেআউড বানিয়েছে—সেগুলোও ফ্রিতে ডাউনলোড করা যায়।
লিপিঘরের সিনিয়র ব্যবস্থাপকরা অনেক তরুণ ডিজাইনারদের নতুন টাইপফেস বানাতে উৎসাহ জুগিয়েছেন, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম নতুন ফন্ট তৈরিতে অবদান রাখতে পারে। নতুন প্রজন্মের ডিজাইনারদের একজন আলিনুর ইসলাম, লিপিঘরের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
আলিনুর লিপিঘরের খোঁজ পান ২০১৮ সালে। তিনি শখের বশে একটি ফেসবুক পেজ চালাতেন। লিখতেন স্মার্টফোন দিয়ে। ওই সময় স্মার্টফোনের জন্য হাতেগোনা কয়েকটি বাংলা ফন্ট ছিল। আলিনুর লিপিঘরের নতুন বাংলা ফন্ট ডাউনলোড করেন। এরপর নিজেই নতুন ফন্ট বানানোর জন্য উৎসাহী হয়ে ওঠেন।
আলিনুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এটা একটা অন্যরকম অনুভূতি ছিল। সেই অনুভূতি ঠিক বলে বোঝাতে পারব না।'
একদিন আলিনুর লিপিঘরের ফ্যান ক্লাব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন, যার সদস্যরা ফন্ট প্রকাশের আগে মাসে তিনটি নতুন ফন্ট পাবেন। সদস্যপদ নেওয়ার ফি ঠিক হলো ২০০ টাকা এবং ফন্টগুলোর মধ্যে একটি প্রিমিয়াম ও দুটি সাধারণ ফন্ট থাকবে।
সদস্য হওয়ার পর আলিনুর প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ ব্যবস্থাপক এবং কয়েকজন ফন্ট ডিজাইনার ও ডেভেলপারের সঙ্গে দেখা করেন। তবে এর কদিন পরই লিপিঘর ঘোষণা দেয় যে কিছু সমস্যার কারণে তারা ফ্যান ক্লাবটি বন্ধ করে দেবে।
ওই সময় আলিনুর লিপিঘরের সহপ্রতিষ্ঠাতা নীলাদ্রি শেখর বালা ও শরীফ উদ্দিন শিশিরের সঙ্গে দেখা করেন। নীলাদ্রির কাছে জানতে চান, তিনি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে ফন্ট ডিজাইন করতে পারবেন কি না। নীলাদ্রি তখন আলিনুরকে চেষ্টা করার জন্য উৎসাহ দেন। আলিনুরের কাজে লাগতে পারে, এমন কিছু অ্যাপের নামও বলে দেন।
প্রায় তিন মাস একটি কাজ করে আলিনুর একটি টাইপফেস ডিজাইন করার চেষ্টা করেন। সেই ডিজাইন তিনি লিপিঘরকে দেখান। লিপিঘর জানায়, ডিজাইনটি চলবে। তবে তারা এ-ও জানিয়ে দেয় যে আলিনুর যেহেতু ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের বদলে মোবাইল ফোন দিয়ে টাইপফেসটি ডিজাইন করেছেন, তাই এটি নিখুঁত করতে সময় লাগবে।
আলিনুর তখন সবে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। এরপর তিনি ভর্তি হন রংপুর আইডিয়াল ইনস্টিটিউট অভ টেকনোলজিতে।
লিপিঘরের সমর্থন পেয়ে আলিনুর উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ফন্ট ডিজাইন করার জন্য তিনি এতটাই আগ্রহী হয়ে ওঠেন যে এক বছরে আলিনুর তার মোবাইল ফোন দিয়ে ১২টি টাইপফেস ডিজাইন করে ফেলেন। অনলাইনে নীলাদ্রি শেখর বালা আর তৌফিকুর রহমানও তাকে সাহায্য করতেন।
দেশে করোনা মহামারিজনিত লকডাউন দেওয়ার আগে আলিনুর ঢাকায় আসেন। আরবি সাহিত্যে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন ঢাকার কাজী নজরুল সরকারি কলেজে। লকডাউনের সময় তাকে কুড়িগ্রামে বাড়ি ফিরে যেতে হয়। ওই সময় তিনি বাংলা ফন্টের জন্য টাইপফেস ডিজাইন করতে আরও বেশি সময় পান।
পরে লিপিঘর মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতনে আলিনুরকে ইন-হাউস টাইপফেস ডিজাইনার হিসেবে চাকরির প্রস্তাব দেয়।
আলিনুরের পরিবার খুব একটা সচ্ছল না। ল্যাপটপ কেনা তার পরিবারের কাছে বিলাসিতাই। তবে আলিনুরের যে কাজ, তার জন্য ল্যাপটপ থাকা অত্যাবশ্যক। তখন তিনি ৬৮ হাজার টাকা দিয়ে একটি ল্যাপটপ কেনেন। আলিনুরের কৃষক বাবা তাকে ৩৮ হাজার টাকা দিয়েছিলেন, ঋণ করেও কিছু টাকা জোগাড় করেন তিনি। আর বাকি টাকা আসে তার সঞ্চয় থেকে।
অবশেষে ২০২১ সালে আলিনুর ল্যাপটপ কিনতে পারলেন। ফন্ট নিয়ে আলিনুর এতটাই আচ্ছন্ন ছিলেন যে তিনি ফন্ট ডিজাইন করা ছাড়া আর কিছুই করতেন না। ওই বছরই আলিনুরের প্রথম ফন্ট আলিনুর২১ প্রকাশিত হয়।
২০২২ সালে লিপিঘরের একজন শীর্ষ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন। যাওয়ার সময় কয়েকজন টাইপফেস ডিজাইনারও নিয়ে যান তিনি। একই সঙ্গে তৌফিকুর রহমানও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এতে কোম্পানিটি একটা ধাক্কা খায়। এ সময় এক বিকেলে আলিনুরকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
এ ধরনের দায়িত্ব নিতে পুরোপুরি প্রস্তুত না থাকলেও, শেষ পর্যন্ত আলিনুর প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন।
লিপিঘর এ পর্যন্ত ২২০টিরও বেশি ফন্ট প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে আলিনুর একাই ডিজাইন করেছেন সর্বোচ্চ ৭২টি ফন্ট।
কীভাবে চলে লিপিঘরের ব্যবসা
লিপিঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল মূলত নানা ধরনের ফ্রি ফন্ট দেওয়ার জন্য। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি পরে দেখল গুগল অ্যাডসেন্স থেকে আসা আয় দিয়ে ফাউন্ড্রি চালানো কঠিন। আগে তারা ফ্রি ফন্টের ওপর বেশি জোর দিত। তবে গত কয়েক মাস ধরে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এবং ফন্ট টাইপফেস ডিজাইনার ও ফন্ট ডেভেলপারদের বেতন দিতে তারা প্রিমিয়াম ফন্টের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে।
লিপিঘর দুইভাবে আয় করে। একটি হলো প্রিমিয়াম (প্রতিটি ১০০ টাকায়) ও ফ্রিমিয়াম (প্রতিটি ২০ টাকা মূল্যে) ফন্ট বিক্রি। ফ্রিমিয়ামের জন্য ক্রেতারা বাংলা ফন্টের মৌলিক বর্ণমালা পাবেন, যৌগিক বর্ণমালা পাবেন না।
আর দ্বিতীয় উপায় হলো গুগল অ্যাডসেন্স থেকে আসা আয়। আলিনুর ইসলাম জানান, ফাউন্ড্রিটির মাসিক আয় ৩ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, কোম্পানিটি ডিজাইনারদের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকায় একটি টাইপফেস ডিজাইন কেনে। টাইপফেস ডিজাইনাররা ফন্ট প্রকাশের সময় ২ হাজার টাকা পান। ফন্টের ডাউনলোড ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেলে ডিজাইনাররা বাকি ৩ হাজার টাকা পান।
একটি প্রিমিয়াম ফন্টের জন্য লিপিঘর টাইপফেস ডিজাইনারকে সাত কিস্তিতে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে থাকে।
তবে এই কাজটি অত্যন্ত কঠিন। আলিনুরের মতে, একজন দক্ষ ব্যক্তির একটি টাইপফেস ডিজাইন করতে প্রায় ১০ দিন সময় লাগে এবং টাইপফেস থেকে একটি ফন্ট তৈরি করতে সময় লাগে পাঁচ দিন।
ফ্রিল্যান্স টাইপফেস ডিজাইনার ছাড়াও নীলাদ্রি শেখর বালা, নুরুল আলম আদর এবং আলিনুর ইসলাম লিপিঘরের জন্য টাইপফেস ডিজাইন করে থাকেন। স্টাফ ও ফ্রিল্যান্সারসহ প্রায় ৪০ জন ফন্ট ডেভেলপার লিপিঘরের জন্য কাজ করেন।
লিপিঘরের সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড হওয়া ফন্টটি ডিজাইন করেছেন এইচ এম মাহফুজ। তার ফন্টটি ৪ লাখ ৯০ হাজারবারের বেশি ডাউনলোড করা হয়েছে।
টাইপফেস ডিজাইন করার প্রতি আলিনুরের তীব্র আবেগ থাকলেও তিনি বলেন যে, খুব কম মানুষই এই লাইনে কাজ করতে আসেন। এছাড়া এ কাজ করে পরিবার চালানোর জন্য খুব বেশি কিংবা পর্যাপ্ত টাকাও পাওয়া যায় না বলে জানান তিনি।
লিপিঘর ফন্টে আরও অনেক বৈচিত্র্য আনতে চাইছে। একই সঙ্গে বাংলা বর্ণমালা দিয়ে মোবাইল কিবোর্ড তৈরির কাজও করছে প্রতিষ্ঠানটি।
তবে লিপিঘরকে একটি সমস্যাও পোহাতে হয়। তারা একটি ফন্ট বিক্রি করে একজন ব্যক্তির ব্যবহারের জন্য। কিন্তু কিছু লোক এই ফন্টগুলো কিনে নিয়ে টেলিগ্রামে বিভিন্ন গ্রুপে বিক্রি করে। এতে লিপিঘরের আয় কমে যাচ্ছে।