হিমালয়ে হারিয়ে যাওয়া এক ক্যামেরার খোঁজে: পাওয়া গেলে বদলে দিতে পারে এভারেস্ট জয়ের ইতিহাস
পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের উত্তর পাশের কোনো এক জায়গায় বরফের মধ্যে ডুবে আছে কোডাকের তৈরি পুরোনো একটি ভেস্ট পকেট ক্যামেরা। নিদেনপক্ষে হিমালয়ের ওই অঞ্চলের কোথাও ক্যামেরাটি থাকা উচিত। ওই ক্যামেরার ফিল্মগুলো এভারেস্টের ইতিহাস নতুন করে লেখার জন্য যথেষ্ট।
১৯২৪ সালে ক্যামেরাটি হারিয়ে যায় এভারেস্ট অভিযানে যাওয়া জর্জ ম্যালরি ও তার সহ-অভিযাত্রী আরভিনের সঙ্গে। ১৯৯৯ সালে ম্যালরির মৃতদেহ হিমালয়ে খুঁজে পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়েছিল, তার মৃতদেহের সঙ্গেই ক্যামেরাটি পাওয়া যাবে, কিন্তু তা আর হয়নি — ক্যামেরাটি এখনো অধরাই রয়ে গেছে।
ম্যালরির কাছে যেহেতু ক্যামেরাটি ছিল না, তাহলে অ্যান্ড্রু আরভিনের সঙ্গেই এটি থাকার কথা। আরভিনের মৃতদেহের এখনো কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তার সঙ্গে থাকা ক্যামেরাটি পাওয়া গেলে হয়তো একটি চমকপ্রদ প্রশ্নের উত্তর মিলতে পারে: ম্যালরি আর আরভিনই কি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এভারেস্ট জয় করেছিলেন?
ম্যালরির মৃতদেহ
১৯৯৯ সাল। ম্যালরি অ্যান্ড আরভিন রিসার্চ এক্সপিডিশন-এর কনার্ড অ্যাংকার হিমালয়ের ৮,২০০ মিটার উঁচুতে অনুসন্ধান চালাচ্ছিলেন। উবু হয়ে বসে জুতার ফিতা ঠিক করার সময় পায়ের কাছে অদ্ভুত কিছু খেয়াল করলেন। বায়ুপ্রবাহের কারণে পর্বতের ওপরের অংশে অনেক সময় বরফ আর তুষার সরে গিয়ে পাথর বেরিয়ে পড়ে।
এরকমই একটি স্থানে বরফের তলা থেকে ম্যালরির প্রায় মমি হয়ে যাওয়া মৃতদেহ বেরিয়ে পড়েছিল। অ্যাংকারের বুটের পাশেই পড়ে ছিল ম্যালরির মৃতদেহ। তার এক পায়ে জুতা নেই, সেটা অন্য পায়ের ওপর উঠে গেছে। দ্বিতীয় পায়ে একটা খুব পুরোনো চামড়ার বুট।
ম্যালরির কোমরে ক্ষয়ে যাওয়া দড়িটা তখনো লাগানো ছিল। পরনে এভারেস্ট অভিযানের প্রথমদিককার সময়ের পোশাক। মৃতদেহটির মাথায় খাড়া সোনালী ধাঁচের চুল দেখে অ্যাংকার মনে করেছিলেন তিনি বুঝি আরভিনের মৃতদেহ আবিষ্কার করেছেন। কারণ ম্যালরির চুল ছিল বাদামি।
কিন্তু পরে অ্যাংকার ও তার সঙ্গীরা মৃতদেহটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে এটির শার্টের কলারের লেবেল বুঝতে পারলেন ওটা আসলে ম্যালরির দেহাবশেষ। ৭৫ বছর ধরে বরফ-বাতাসের সংস্পর্শে এসে কিছুটা সাদাটে হয়ে গিয়েছিল তার চুল।
ম্যালরির দেহের ছয়স্তরের পোশাকের ভেতর অনুসন্ধান চালিয়ে তারা অনেককিছুই খুঁজে পেলেন: এক বাক্স ম্যাচ, তিনটা চিঠি, একটা রুমাল, একটা পকেট ছুরি, একটা ভাঙা অল্টিমিটার, সেলাই করার জিনিসপাতির একটা কিট ইত্যাদি। কিন্তু ক্যামেরাটার কোনো অস্তিত্ব কোথাও পাওয়া গেল না।
ওই ক্যামেরাটির মূল মালিক ছিলেন হাওয়ার্ড সমারভিল — ১৯২৪ সালের ওই ব্রিটিশ এক্সপিডিশনের আরেকজন অভিযাত্রী। ম্যালরিকে নিজের ক্যামেরাটা ধার দিয়েছিলেন তিনি। এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার পর স্ত্রী রুথের একটি ছবি রাখতে চেয়েছিলেন ম্যালরি। কিন্তু তার মৃতদেহে ওই ছবিটিরও কোনো অস্তিত্ব পাওয়া গেল না।
কোডাকের টেকনিশিয়ানরা অ্যাংকারের দলকে নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন, ক্যামেরাটা ক্ষতিগ্রস্ত না হলে — কয়েক দশক ধরে বরফের নিচে জমে থাকা সত্ত্বেও — এর ভেতরের ফিল্মটা উদ্ধার করা যাবে। আর যদি ফিল্ম থেকে কোনো ছবি সফলভাবে ডেভেলপ করা যায়, তাহলে ম্যালরি-আরভিন এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে পেরেছিলেন কি না সে রহস্যের কিনারা করা যাবে।
১৯৭৫ সালে ওয়াং হংবাও নামক একজন চীনা পর্বতারোহী এভারেস্টে ওঠার সময় ৮,১০০ মিটার উচ্চতায় একটি লাশ দেখেছিলেন। ওই লাশটি কোনো 'ইংরেজের' হবে বলে ধারণা করেছিলেন ওয়াং। তার দেওয়া বর্ণনার ওপর ভিত্তি করেই অ্যাংকার ও তার দল ম্যালরিদের মৃতদেহ খুঁজতে শুরু করেছিলেন।
ওই সময় আর কোনো পর্বতারোহীর অত উচ্চতায় মারা বা হারিয়ে যাওয়ার কথা জানা ছিল না। তাই ওই মৃতদেহ ম্যালরি বা আরভিনেরই হওয়ার কথা। ম্যালরির মৃতদেহ পাওয়ার খবর সারাবিশ্বের গণমাধ্যমগুলো তখন বড় করে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপিয়েছিল।
আরভিনের খোঁজে
অ্যাংকার ও তার সঙ্গীরা ম্যালরির দেহাবশেষ পাথরচাপা দিয়ে কবর দেন। কিন্তু আরভিন আর ওই হারানো ক্যামেরার অনুসন্ধান থেমে যায়নি। সর্বশেষ ২০১৯ সালে কিছু নতুন তথ্যের বরাতে মার্ক সিনট আরভিনের মৃতদেহ অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
১৯৩৮ সালের পর থেকে এভারেস্টের তিব্বতের অংশে কেউ পা রাখেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীন এর সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে নেপাল সীমান্ত খুলে দিয়ে হিমালয়ে পর্বতারোহণের জন্য আগ্রহীদের আমন্ত্রণ জানায়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৩ সালে তেনজিং নোরগে ও এডমন্ড হিলারি প্রথমবারের মতো এভারেস্ট জয় করেন।
১৯৬০ সালে চীনের পর্বতারোহীরা প্রথমবারের মতো এভারেস্ট জয় করেন। ওই দলের একজন পর্বতারোহী ওয়াং ফুজু ১৯৬৫ সালে রাশিয়ায় এব সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছিলেন, এভারেস্টের ৮,৬০০ মিটার উচ্চতায় তিনি ব্রেস পরা একজন ইউরোপীয়র লাশ দেখেছিলেন।
আরভিনও ব্রেস পরতেন। তবে ওয়াং স্পষ্ট করে জানাননি ঠিক কোন জায়গায় তিনি ওই মৃতদেহ দেখেছিলেন। ১৯৬৫ সালে শেরপা শিরিং দোরজেও দাবি করেন, তিনি ৮,৪০০ মিটার উচ্চতায় সামরিক পোশাক পরা অনেক পুরোনো একটি লাশের দেখা পেয়েছিলেন। এর আগে ১৯৬০ সালে শু জিং নামক আরেকজন চীনা পর্বতারোহীও একই উচ্চতায় ওই লাশটি দেখার দাবি করেন।
চীন ম্যালরি ও আরভিনের এভারেস্ট জয় করার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছে। বেইজিংয়ের দাপ্তরিক কাগজপত্র বা আলাপেও শু জিং ও ওয়াং ফুজুর সাক্ষ্য মুছে ফেলা হয়েছে। অনেকে ধারণা করেন, ২০০৮ সালের একটি অভিযানে চীন আরভিনের মৃতদেহ এভারেস্ট থেকে সরিয়ে ফেলেছে। তবে এর পক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ নেই।
এভারেস্টের ৮,৬০০ মিটার উচ্চতায় ম্যালরি ও আরভিনকে সর্বশেষ জীবিত দেখেছিলেন নোয়েল ওডেল। ১৯২৪ সালের ৮ জুলাই এভারেস্টে চূড়ায় ম্যালরি আর আরভিনকে দেখেছিলেন বলে নোয়েলের বিশ্বাস — এমনকি নিজের এ বিশ্বাসে সবসময় অনড় ছিলেন তিনি। তার এ কথাই ম্যালরি-আরভিন রহস্যকে এখোন জিইয়ে রেখেছে আজ একশ বছর পরেও, কোনো একদিন সমাধান হওয়ার আশায়।