বৈরী সব বিষয় নিয়ে চীনে ব্লিঙ্কেন, শি’র সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে কি?
কয়েক দফা পেছানোর পর অবশেষে চীন সফর করছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। দুই পরাশক্তির উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে নজর এখন পুরো বিশ্বের। দুই দেশই এমন সব এজেন্ডা নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছে, যেগুলো অমীমাংসিত থেকেই শেষ হতে পারে ব্লিঙ্কেনের বেইজিং সফর। এমন শঙ্কার মাঝে ঘুরেফিরে সামনে আসছে আরও একটি প্রশ্ন, চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ব্লিঙ্কেনের কি মুখোমুখি বৈঠক হবে?
ব্লিঙ্কেন রোববার (১৮ জুন) বেইজিং পৌঁছেছেন। ২০১৮ সালের পর থেকে চীনে কোনো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম সফর এটি। গত ফেব্রুয়ারিতে এই সফর শুরু হওয়ার কথা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনা নজরদারি বেলুন ভেসে বেড়ানোর ঘটনায় এটি পিছিয়ে যায়। দুই পরাশক্তির মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেয়।
ব্লিঙ্কেন এবং অন্যান্য মার্কিন কর্মকর্তারা আশা করছেন, এবারের সফর দুই দেশের মধ্যে নতুন কূটনৈতিক যুগের সূচনা করবে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সফর ঘিরে চীনের নিশ্চুপ থাকা এই আশঙ্কা তৈরি করছে যে, বেইজিংয়ের বৈঠকটি সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে না হয়ে শত্রুভাবাপন্ন অবস্থান নিয়ে শেষ হতে পারে।
দুই দেশই বিভিন্ন ইস্যু ও অভিযোগের লম্বা তালিকা নিয়ে দুই দিনের এই বৈঠকে বসতে যাচ্ছে। বিষয়গুলোই ঠিক করে দেবে নিকট ভবিষ্যতে বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্পর্ক মেরামত হবে কি না।
দিয়াওইউতাই স্টেট গেস্টহাউসে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং-এর সঙ্গে রোববার বিকেলেই প্রথম বৈঠক শুরু করেছেন ব্লিঙ্কেন। কিন গ্যাং কয়েকমাস আগেই ওয়াশিংটনে চীনের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া ছাড়াই তারা বৈঠক শুরু করেন।
কী কী বিষয় সামনে আনবে যুক্তরাষ্ট্র?
মার্কিন কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলছেন, উচ্চ পর্যায়ের কূটনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা তাদের অগ্রাধিকার। তারা বলছেন, সংকটের সময় বাড়তে পারে এমন বিদ্যমান উত্তেজনা প্রশমিত করতে উভয় পক্ষের মধ্যে যোগাযোগের চ্যানেল স্থাপন করা প্রয়োজন।
এ ছাড়া বৈঠকের বড় অংশজুড়ে থাকতে পারে নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে আলোচনা। চীনের চারপাশের সমুদ্রপথে প্রায়ই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে চীনের সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের প্রচেষ্টায় তীক্ষ্ণ নজর রাখছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকে প্রাণঘাতী সামরিক অস্ত্র না দিতে বেইজিংকে সতর্কও করেছে ওয়াশিংটন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিভাগের পূর্ব এশিয়া বিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা ড্যানিয়েল জে ক্রিটেনিব্রিঙ্ক বলেন, ব্লিঙ্কেন চীনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মতো যৌথ স্বার্থ আছে এমন বিষয়ে আলোচনা করার পরিকল্পনা করেছেন।
ব্লিঙ্কেন চীনে আটক হওয়া, কারাগারে থাকা কিংবা দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়া মার্কিন নাগরিকদের মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানাতে পারেন। পাশাপাশি দুই দেশের অল্পসংখ্যক সাংবাদিককে ভিসা প্রদানের মতো 'পিপল টু পিপল এক্সচেঞ্জ' পরিকল্পনা পুনরায় চালু করার প্রস্তুব দেবেন তিনি। বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতির আগে বিষয়টিতে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছিল।
মার্কিন কর্মকর্তারা আরও জানান, তারা ফেন্টানাইল তৈরিতে ব্যবহৃত পদার্থের রপ্তানি সীমিত করার বিষয়ে চীনের সাথে কথা বলার প্রত্যাশা করছেন। ফেন্টানাইল এটি এমন একটি ওষুধ যা যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশে মাদক হিসেবে ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হচ্ছে।
যেমন হতে পারে চীনের অবস্থান
যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক আধিপত্য কমে আসছে। চীনকে তাই অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনীতিকভাবে কোণঠাসা করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। বেইজিং তার এমন দৃষ্টিভঙ্গি বৈঠকে তুলে ধরে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করতে পারে।
বৈঠকে চীনের শীর্ষ আলোচ্য বিষয় হতে পারে তাইওয়ান ইস্যু। স্বশাসিত এই দ্বীপকে তার নিজের ভূখণ্ডের অংশ বলে দাবি করে চীন। আর তাইওয়ান সামরিক সহায়তা পায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
চীনের প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাইওয়ানের 'স্বাধীনতার পক্ষের' শক্তিকে সমর্থন এবং চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ করেছেন।
চীনে উন্নত সেমিকন্ডাক্টর চিপ ও উৎপাদন সরঞ্জাম রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা নিয়েও নিজেদের গভীর হতাশা করতে পারে বেইজিং। যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য হলো, এসব মার্কিন প্রযুক্তি যাতে চীনা সামরিক বাহিনীর হাতে না পড়ে তাই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপ চীনের প্রযুক্তিগত বিকাশকে পিছিয়ে দেবে।
বৈঠকে বেইজিং ওয়াশিংটনকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে নিরাপত্তা সম্পর্ক গভীর করার মাধ্যমে সংঘাতের উসকানি দেওয়ার চেষ্টায় অভিযুক্ত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চীনের চাওয়া হলো, যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে সমশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিক। যাতে বেইজিং বিশ্বমঞ্চে সমান অবস্থান পায় এবং এশিয়ায় মার্কিন সামরিক উপস্থিতির কারণে হুমকি বোধ না করে।
জিনপিং কি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে দেখা করবেন?
সফরকে ঘিরে সবচেয়ে বড় প্রশ্নই হলো, চীনের প্রেসিডেন্ট কি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে দেখা করবেন? গত সপ্তাহেও ব্লিঙ্কেনের পূর্ণাঙ্গ সূচি ঠিক করতে কাজ করে গেছে দুই দেশের কর্মকর্তারা। তবে সম্ভবত শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত বিষয়টি ঝুলে আছে। রোববার এবং সোমবারের সকালের বৈঠক কেমন যায় তার ওপর নির্ভর করতে পারে জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে কি হবে না।