নামহীন এক স্কুল: নির্জন চরে আশার আলো
চলতি বছর জুনে পদ্মা নদীর ভিন্ন এক চিত্র দেখা গেছে। আগের মতই প্রশস্ত ও একইভাবে প্রবাহিত হলেও এবার পদ্মার পানির স্তর ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটা নিচে। তাই দশ বছর আগে পদ্মায় জেগে ওঠা চর কুশাহাটার বাসিন্দারা তাদের উচ্চ ফলনশীল জমিতে সহজেই চাষাবাদ করতে পারছিলেন।
প্রতি বছর জুনের মধ্যে তাদের বেশিরভাগ জমি সাধারণত পানির নিচে চলে যায়। কিন্তু এ বছর চাষাবাদের সময় বেড়েছে। ইরি বা বোরো ধানের পাশাপাশি তারা তিল, ভুট্টা ও সরিষা চাষ করছেন।
আমরা কুশাহাটায় গিয়েছিলাম চরের ওয়াজউদ্দিনের স্কুল দেখতে ও সেখানের স্থানীয় বাসিন্দারের সঙ্গে কথা বলতে। এক বিবাহিত দম্পতি এই বেসরকারি স্কুলটি পরিচালনা করেন।
আমাদের মূল ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের থেকে চরের জীবন অনেকটাই ভিন্ন। মাত্র একদিনের জন্য এমন জীবনযাপনের মাধ্যমে কোনো আগন্তুক ধৈর্যের মতো গুণ শিখতে পারবেন। চর জীবনের অনেক দিক আছে যেগুলো আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকবে। তারমধ্যে একটি হলো পরিবহন।
আমরা প্রথম খেয়ায় উঠতে পারিনি। পরের খেয়া পেতে আমাদের দুই ঘণ্টার বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে আন্তারমোড় ঘাটে। এখান থেকে চরগামী খেয়া চলাচল করে। নৌকা মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে কেউ চাইলেই নিজের জন্য খেয়া রিজার্ভ করতে পারেন না।
আমাদেরকে একটি দ্বীপের ধারে নামিয়ে মাঝি বললেন এটা চর কুশাহাটা। তখন ভরদুপুর, অসহ্য গরম। তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও চারপাশের জলাভূমির মাঝে অনুভব হচ্ছিল আরও বেশি।
সেখানে এমন একটি গাছও ছিল না যারা ছায়ায় দাঁড়িয়ে স্বস্তি পাওয়া যাবে। উল্টো ধারালো আগাছার মধ্য দিয়ে হাঁটার সময় সেগুলো আমাদের শরীরে খোঁচা দিচ্ছিল।
প্রায় ৩০ মিনিট উত্তপ্ত ঝোপের মধ্যে ঘোরাঘুরি করার পরে অবশেষে আমরা টিনশেড ঘরগুলো দেখতে পেলাম। তার মধ্যে একটিতে জাতীয় পতাকা দেখতে পেয়ে বুঝতে পারলাম আমরা কাঙ্ক্ষিত স্কুলটি খুঁজে পেয়েছি।
ওয়াজউদ্দিন ছিলেন পোশাক শ্রমিক। চর কুশাহাটায় নিজেদের বাড়ি বানানোর আগে তার স্ত্রী রওশন আরাও পোশাককর্মী হিসেবে কাজ করতেন।
১৯৯০ সাল পর্যন্ত কুশাহাটা রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার মূল ভূখণ্ডের একটি অংশ ছিল। ৯০-এর দশকে শক্তিশালী পদ্মার ভাঙনে ক্ষয় হওয়া গ্রামগুলোর একটি এই কুশাহাটা।
আর সেই ঘটনায় ওয়াজউদ্দিন, নেয়ামত, শামেলা, মুকুল, ইখলাস, অনিক এবং আরও অনেক বাসিন্দা — যাদের আমরা সাক্ষাৎকার নিয়েছি — গৃহহীন হয়ে পড়েন। কেউ আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন চরে, কেউ থেকেছেন মূল ভূখণ্ড রাজবাড়িতে অন্যের জমিতে। তাদের মধ্যে অনেকেই অনিশ্চিত জীবনযাপন করেছেন।
এক দশকেরও কম সময় আগে পদ্মায় একটি চর উঠলে বাসিন্দারা এটিকে কুশাহাটা হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং ওয়াজউদ্দিনের মতো কয়েকশ লোক সেখানে পুনর্বাসিত হন। বর্তমানে চর কুশাহাটায় প্রায় ১৩০টি পরিবার বসবাস করছে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত চরের বাসিন্দারা প্রথমে ব্র্যাকের তহবিলের মাধ্যমে তাদের স্কুল চালু করে, যা ২০১৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এক বছর ধরে চলে।
২০১৮ থেকে এ বছরের মে মাস পর্যন্ত ওয়াজউদ্দিন এবং রওশন আরা তাদের নিজস্ব আঙ্গিনায় স্কুলটি পরিচালনা করছিলেন। পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করত পিয়াক্ট বাংলাদেশ নামক একটি বেসরকারি সংস্থা। এরপর স্কুলের জন্য একটি টিনের ঘর তৈরি করা হয়।
ওয়াজউদ্দিনই বেশিরভাগ সময় ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শতাধিক শিক্ষার্থীর ক্লাস নিতেন। তিনি বলেন, আমরা জানি শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আমারও মেয়ে আছে, যার শিক্ষা প্রয়োজন।
ওয়াজউদ্দিন আরও বলেন, আমি এই সমস্ত বাচ্চাদের একাই পড়াচ্ছি। অবশ্যই আমার স্ত্রী সহায়তা করেছে। আমি এই স্কুল থেকে পাঁচ থেকে আট হাজার টাকা উপার্জন করি। এই অর্থ দিয়ে আমার সংসার চালাতে পারি না। তাই আমাকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। মাঝে মাঝে আমি সেলাই করি এবং ক্ষেতে কাজ করি।
ওয়াজউদ্দিনের বেতন আসে চরের বাসিন্দাদের সামান্য চাঁদা থেকে। যে পরিবার থেকে একজন পড়তে আসে তারা বেতন দেয় ১৫০ টাকা। দুইজন হলে বেতন প্রত্যেকের জন্য ১০০ টাকা করে। আর তৃতীয় সদস্য থাকলে পড়ে বিনামূল্যে।
স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান সম্প্রতি ওয়াজউদ্দিনের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি টিনশেড স্কুল নির্মাণ করেছেন এবং মে মাস থেকে সেখানে ক্লাস শুরু হয়েছে। তবে, রওশন আরার এসএসসি (মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট) ডিগ্রি না থাকায় তাকে আর পড়াতে না করা হয়েছে।
ওয়াজউদ্দিন এখন শামেলা নামক একজন সহকারী নিয়েছেন যিনি এইচএসসি (উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট) ডিগ্রিধারী। ওয়াজউদ্দিন নিজে এসএসসি পাস করেছেন।
রওশন আরা বলেন, 'আমি শেখাতে এবং বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করতাম। আমি এখনও তাদের শেখাতে চাই। অলস বসে থাকতে ভালো লাগে না। সেই দিনগুলো মিস করি।'
নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শামেলা চর কুশাহাটা সম্পর্কে আমাদের তথ্য দেন। তিনি বলেন, 'চরের বাসিন্দারা অশিক্ষিত। লোকেরা মাঠে কাজ করে। কেউ মাছ ধরে, কেউ অন্যের বাড়িতে কাজ করে।'
'পদ্মায় তাদের বাড়িঘর বিলীন হওয়ার পরে, বেশিরভাগ মানুষ মাছ ধরাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। তারা এখনও একই রকম আছে, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কিছুটা উন্নতি করেছে।'
স্কুলটি তৈরি হয়েছে বালু দিয়ে উঁচু করা একটি জায়গায়। গ্রামবাসীদের জড়ো হওয়ার জায়গাও এটি। আমরা প্রখর রোদের মধ্যে সেখানের বারান্দায় প্রাণীদের আশ্রয় নিতেও দেখেছি।
টয়লেট বা ফ্যানের মতো মৌলিক কোনো সুযোগ-সুবিধা এখনো স্কুলে নেই। ওয়াজউদ্দিন ও শিক্ষার্থীদের গরম থেকে বাঁচানোর জন্য আশেপাশে একটি গাছও নেই এবং চরবাসী বিদ্যুৎ পেয়েছে মাত্র দুই বছর হলো।
স্কুলের বারান্দায় বসে থাকা গ্রামের দুই নারী অবশ্য লোডশেডিংয়ের কারণে বিদ্যুৎ পরিষেবা নিয়ে খুশি নন। তাদের একজন বলেন, সারাক্ষণ লোডশেডিং থাকলে বিদ্যুৎ দিয়ে কাজ কী?
যোগাযোগ ব্যবস্থা চরবাসীর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পেতে পদ্মা দিয়ে কয়েক কিলোমিটার পাড়ি দিতে হয় তাদেরকে। তারজন্যও বসে থাকতে হয় আন্তরমোড় থেকে চর কাশিমনগরের মধ্যে খেয়া চালানো মাঝিদের অপেক্ষায়।
ইখলাস প্রামাণিক নামক এক ছাত্র বলে, 'আমাদের স্কুলে টয়লেট দরকার। পাখা দরকার। খুব গরম।' ইখলাস পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। পড়ালেখা চালিয়ে যেতে চাইলে তাকে রাজবাড়ী, আরিচা বা অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। কারণ ওয়াজউদ্দিনের স্কুলে শুধুমাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ায়।
যা-ই হোক না কেন, এই শিশুরা তাদের প্রিয় 'স্যার' ওয়াজউদ্দিনকে অত্যন্ত সম্মান করে। চর প্লাবিত হলে তিনি শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে তুলে এনে নৌকায় করে স্কুলে নিয়ে যান।
ওয়াজউদ্দিন বলেন, অন্য পেশা বেছে নিলে আমি হয়তো আরও ভালো উপার্জন করতে পারতাম। কিন্তু আমি এখনও শিক্ষকতা করছি, কারণ আমি চাই না এই শিশুরা নিরক্ষর থাকুক।