থ্রি ইডিয়টস, পিকে সিনেমার দৃশ্য রিমেক করে জিসান এখন ‘বাংলাদেশি পিকে’
একটা করে চশমা ও বালতি কিনতে পকেট থেকে খরচা হয়েছিল ৩৭০ টাকা। এই টাকা দিয়েই তৈরি করা হয় বলিউডের বিখ্যাত সিনেমা থ্রি ইডিয়টস-এর আংশিক রিমেক (পুননির্মাণ)। সিনেমার কয়েকটি দৃশ্য বাছাই করে পরিচিত অন্য শৌখিন অভিনেতাদের সহযোগিতায় হুবহু তা রিমেক করেন তরুণ এক অভিনয়প্রেমী।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থ্রি ইডিয়টস সিনেমার পাঁচ মিনিটের সেই রিমেক ভিডিও দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। অল্প সময়ে এত বেশি সাড়া পাওয়ায় তরুণ নির্মাতা জিসান আহমেদ বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। প্রথম সাফল্যের উৎসাহে প্রায় চার মাস সময় নিয়ে আমির খানের পিকে সিনেমার কিছু দৃশ্যের রিমেক তৈরি করে ফেলেন জিসান।
নিজেই পরিচালক, নিজেই অভিনেতা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী জিসান আহমেদের স্বপ্ন বড় অভিনেতা হওয়ার। বাণিজ্যিক সিনেমায় ডাক না পেলেও নাটক ও নাট্যতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে নিজেই সিনেমা তৈরি করে সেগুলোতে অভিনয় শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ভিডিও তৈরির ক্ষেত্রে একাই পরিচালকের ভূমিকায় থেকে দিক নির্দেশনা দিতেন, আবার সেগুলোর মূল চরিত্রে অভিনয়ও করতেন। ক্যামেরা না থাকায় হাতের মুঠোফোন দিয়েই করতেন সিনেমার শ্যুটিং। তার এই কাজের সহযোগী হিসেবে ছিলেন সহপাঠী ও বিশ্ববিদ্যালয়টির হলের বড় ভাইয়েরা।
বড় বাজেট দিয়ে আড়াই ঘন্টার সিনেমা বানানোর মতো সামর্থ্য শিক্ষার্থী জিসানের নেই। তাই হলের বড় ভাই-সহপাঠীদের ব্যবহৃত পোশাক, সাইকেল, বালতি ও টুকিটাকি জিনিস চেয়ে এনে বিখ্যাত সব সিনেমার কয়েক মিনিটের রিমেক ভিডিও বানানো শুরু করেন।
শুরুর গল্প জানাতে গিয়ে জিসান আহমেদ বলেন, 'ছোটবেলা থেকে বন্ধুরা আমাকে নিয়ে মজা করত — আমার গায়ের রং ও বাহ্যিক চেহারা দেখে ওরা হাসি-তামাশা করত। ওদের ধারণা ছিল আমি অভিনেতা হতে পারব না। একবার আমি অভিনয় করে পুরস্কার জেতার পর বন্ধুরা আমার ট্রফি হাতে নিয়ে ঠাট্টা করছিল। এগুলো দেখে আমার খুব মন খারাপ হতো। চাপা সে কষ্ট থেকে ছোটবেলায় স্থির করি বড় হয়ে অভিনেতাই হব।
'জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে অভিনয়ে ওপর ভালো পড়াশোনা হয় শুনে সেখানেই ভর্তি হয়ে যাই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি দক্ষতা বাড়াতে সিনেমার রিমেক বানানোর সিদ্ধান্ত নিই। তখনো ভাবিনি এত অল্প সময়ে মানুষের এত প্রশংসা পাব।'
হলিউডের জোকার; বলিউডের থ্রি ইডিয়টস, পিকে; তামিল ভাষার সিনেমা ৯৬; বাংলাদেশি সিনেমা আয়নাবাজি ও মনপুরা-এর কিছু দৃশ্যের পুননির্মাণ করে ইতোমধ্যে বেশ প্রশংসা পেয়েছেন জিসান। বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে মোট ১০টি সিনেমার আংশিক রিমেক জিসানের 'জিসু এন্টারটেইনমেন্ট' পেজ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।
জিসান জানান, প্রতিটি ভিডিও তৈরি করতে তার প্রায় তিন–চার মাস সময় লেগে যায়। ক্লাস-পরীক্ষার ফাঁকে সাপ্তাহিক ছুটির দুদিন শ্যুটিংয়ের জন্য রাখা হয়। সহাভিনেতাদের সঙ্গে সময় মেলাতে অনেক সময় অসুবিধা হয় বলে এক একটি রিমেক তৈরি করতে সব মিলিয়ে বেশ দীর্ঘ সময় লেগে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় ও আশেপাশের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে সিনেমার সঙ্গে মিল রয়েছে এমনসব স্থান খুঁজে বের করা হয় শ্যুটিংয়ের জন্য। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আয়তনে বড় হওয়ায় জিসানের জন্য আশীর্বাদস্বরুপ হয়েছে বলে জানান তরুণ এই নির্মাতা।
স্বল্প টাকায় স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা
কখনো হাতখরচা বাঁচিয়ে, কখনো আবার রিক্সায় না চড়ে টাকা জমাতেন জিসান। এই অল্প টাকা দিয়েই থিয়েটারে অভিনয় শিখতে ছুটে যেতেন। পরিবারের সমর্থন না থাকায় হাত খরচ দিয়েই নিজ উদ্যোগে সিনেমার দৃশ্য পুননির্মাণ করা শুরু করেন। মনপুরা সিনেমার দৃশ্য রিমেক করতে তার ২,০০০ টাকা খরচ হয়েছিল। থ্রি ইডিয়টস সিনেমার ক্ষেত্রে লেগেছিল কেবল৩৭০ টাকা। তবে প্রতিটি কাজের পেছনে টাকার অংক কম থাকলেও, শ্যুটিংয়ের জন্য অর্ধশতাধিক থেকে শতাধিকের ওপর মানুষ প্রয়োজন হয়েছিল তার। আর এদের বেশিরভাগ স্বেচ্ছায় তার শখের কাজের সঙ্গী হতে রাজি হয়েছিলেন।
জিসান আহমেদ কৃতজ্ঞতার সুরে বারবার তার সেই সঙ্গীদের কথা বলে যাচ্ছিলেন। 'এখন পর্যন্ত আমি কাউকে কোনোরকম পারিশ্রমিক দিতে পারেনি। তবুও এই মানুষগুলো নিজ থেকে আনন্দের সঙ্গে আমার কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। এমনকি যখনই আমি কারও কাছে শ্যুটিংয়ের জন্য এটা-ওটা চাইতাম, তারা ফিরিয়ে দিতেন না। জামাকাপড় থেকে শুরু করে ব্যাগ, বালতি, টুপি, হেলমেট ও প্রয়োজনীয় সবকিছুই আমি হলের পরিচিত ভাই-বন্ধুদের থেকে পেয়েছি।'
জিসানের নির্দেশনা ও অভিনয় দক্ষতা দেখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে স্পনসর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। স্পনসরের প্রযোজনায় প্রথমবারের মতো তিনি ৪০ হাজার টাকা ব্যয়ে পিকে সিনেমার দৃশ্য পুননির্মাণ করেন। এটিই ছিল তার সবচেয়ে ব্যয়বহুল কোনো কাজ। সিনেমায় ব্যবহৃত বলিউড অভিনেতা আমির খানের হাতে থাকা পুরোনো রেডিওর জন্য ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি করতে হয়েছিল তাদেরকে। এমনকি আমির খানের পরা লম্বা স্কার্ট কোথাও খুঁজে না পেয়ে শেষে কাপড় কিনে নিজেরাই সেলাই করে বানিয়ে নিয়েছিলেন।
'রিমেকে সবকিছুর মিল রাখতে পারার কাজটি বড় চ্যালেঞ্জ। জোকার সিনেমার ক্ষেত্রে ব্লেজার এবং পিকে সিনেমার বিভিন্ন জিনিসের জন্য সবচেয়ে বেশি খাটতে হয়েছিল। থ্রি ইডিয়টস সিনেমার রেডিওটি কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না — শেষে যশোরে থাকা এক বন্ধু জানাল তার কাছে এমন একটি রেডিও আছে। তারপর সেখান থেকে রেডিও এনে শ্যুটিং করা হয়েছিল,' বলেন জিসান।
'দৃঢ় মনোবল অভিনয়ে এনেছে'
২০২০ সালে করোনায় ঘরবন্দি থাকার সময় অভিনেতা হয়ে উঠার স্বপ্ন জিসানের মধ্যে চেপে বসেছিল। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে অভিনয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সাত হাজার প্রতিযোগীর মধ্যে জিসান ২য় স্থান অধিকার করেছিলেন। লকডাউনের দিনগুলোতে আয়নাবাজি সিনেমার আংশিক রিমেক তৈরি করেন। যেখানে ৪টি চরিত্রে একাই অভিনয় করে ভিডিওটি নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইল থেকে আপলোড করেছিলেন। তার এই কাজের প্রশংসা পান খোদ সিনেমাটির অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর কাছ থেকে। তারপর থেকেই জিসানের এ শখের নির্মাণ শুরু হয়।
জিসান বলেন, 'পরিবার থেকে চাইত না আমি অভিনয় করি। স্কুলে থাকতে নিজের টাকা দিয়ে থিয়েটার করতাম। থিয়েটার থেকে বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়েছিল বলে একবার গেটের বাইরে রাতভর দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। পরিবার থেকে এখনো চায় না আমি অভিনয়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করি। তবে এখন আর আগের মতো বাধাও দেয় না। ছোট থেকে দীর্ঘ মনোবল আমাকে অভিনয়ে এনেছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই আমার অভিনয়ের প্রশংসা করে, আমাকে জুনিয়র হুমায়ুন ফরিদী হিসেবে ডাকে। তাদের প্রত্যাশা আমিও এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে তার মতো একদিন বড় অভিনেতা হব।'
জিসান এখন নিজের মৌলিক কাজ করার কথা ভাবছেন। বর্তমানে নির্দেশক ও অভিনেতা, দুই ভূমিকায় কাজ করলেও আদতে তার স্বপ্ন বড় অভিনেতা হওয়া। অর্থের জোগান হলে কোনো একদিন তিনি ভালো নির্দেশক হওয়ার পাশাপাশি অভিনেতা হয়ে উঠতে পারবেন বলে তার দৃঢ় বিশ্বাস।