ডেঙ্গু রোগীর উপচে পড়া ভিড় হাসপাতালে, ফাঁকা নেই মেঝেও
৯ দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন মান্ডা এলাকার বাসিন্দা তাসকিনা বেগম (৪০)। মঙ্গলবার টেস্টের পর ডেঙ্গু শনাক্ত হলে ভর্তি হন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তার পাশে বসে ছিল তৃতীয় শ্রেণী পড়ুয়া ছেলে তাসকিন। এ মাসের শুরুতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি ছিলো সেও।
মুগদা হাসপাতালের তৃতীয় তলায় মহিলা ওয়ার্ডে কথা হয় তাসকিনা বেগমের সাথে। তিনি বলেন, "এর আগে আমার দুই ছেলের ডেঙ্গু হয়েছিলো। ওরা সুস্থ হওয়ার পর আমার জ্বর আসলো। ডেঙ্গুর চিকিৎসায় এই এক মাসে আমার ২৫ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে।"
''আমাদের এলাকার বেশিরভাগ মানুষেরই ডেঙ্গু হয়েছে। আমার পাশের বেডে এখন যে আছে সেও আমাদের পাড়ার। রাস্তায় মশার ওষুধ ছিটায় আমরা শুধু কেরোসিনের গন্ধ পাই, কিন্তু গলিতে ওষুধ ছিটায় না,'' তাসকিনা বেগম।
তাসকিনা বেগমের মতো আরো শত শত ডেঙ্গু রোগীর ভিড় মুগদা হাসপাতালে। ওয়ার্ড ছাড়িয়ে তিন তলার সিঁড়ির সামনে পর্যন্ত মেঝে জুড়ে নারী ডেঙ্গু রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন।
শুধু মুগদা হাসপাতাল নয়, ঢাকার অন্যান্য হাসপাতালগুলোতেও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। তবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রোগী ভর্তি হয়েছে মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে।
তিনতলার নারী ওয়ার্ড পেরিয়ে আট তলার শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেলো রোগীর চাপ আরো ভয়াবহ। মেঝেতে বিছানার সারি আর রোগী ও স্বজনদের ভিড়। ৬০ বেডের শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি আছে ২৫০ রোগী। মেঝেতে পাতা একেকটি বিছানায় তিনটি করে শিশু ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে মুগদা হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে কথা হয়, যাত্রাবাড়ি থেকে আসা প্রিয়াংকা আক্তারের সাথে। তিন দিন আগে ১০ মাস বয়সী ছেলে আব্দুল্লাহর ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এই হাসপাতালে আছেন তিনি।
প্রিয়াংকা জানান, ১ তারিখ থেকে জ্বর শিশু আব্দুল্লাহর। তিনদিন পর জ্বর কমেছিলো, তারপর একদিন রাতে তীব্র জ্বর ও বমি। ওষুধে জ্বর না সারায় ডেঙ্গু টেস্ট করে। তারপর সোমবার হাসপাতালে ভর্তি হন। দুই বাচ্চা নিয়ে সবাই তারা এখন হাসপাতালে।
৮ মাসের তাসনিম সিদ্দিকও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের মেঝেতে ভর্তি। যাত্রাবাড়ি থেকে আসা তাসনিমের দাদি সুফিয়া বেগম বলেন, "তিনদিন ধরে এখানে আছি। বাড়িতে সব সময় মশারির নিচে রাখি বাচ্চাকে। যখন খেলে তখন হয়তো মশা কামড়িয়েছে।"
ডেঙ্গু ওয়ার্ডে রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে নার্সেরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নার্স দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ওয়ার্ডে তিন শিফটের প্রতিটিতে ৫ জন করে নার্স কাজ করে। ৫ জনের পক্ষে ১৫০-২০০ রোগীর প্রেশার দেখা, স্যালাইন ঠিক করে দেয়া কঠিন। একেকজন রোগীর সাথে তিন-চারজন করে অ্যাটেনডেন্স আছে, হাঁটাচলারও জায়গা নেই আমাদের। কোন রোগী মশারি টানায় না। বারবার বলার পরও কেউ কথা শোনেনা।"
হাসপাতালটির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, "৫০০ বেডের হাসপাতালে ১১৮৫ জন রোগী ভর্তি আছে। ঢাকা ছাড়াও ঢাকার বাইরের লক্ষীপুর, ফেনী, মাদারীপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ১০% ডেঙ্গু রোগী আসছে আমাদের হাসপাতালে। এখন অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট থেকে রোটেশনে ডাক্তার-নার্স এসে ডেঙ্গু রোগী দেখছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আমাদের কয়েকজন ডাক্তার ও নার্স দিয়েছে। রোগী আরো বাড়লে আরো দুইটি ওয়ার্ড চালু করা হবে।"
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান বলেন, "ডেঙ্গু রোগীর চাপ অনেক বেড়েছে। আমরা পুরুষ ও নারী রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড ডেঙ্গু ওয়ার্ড করেছি। শিশু ডেঙ্গু রোগীদের কর্নার চালু করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সব রোগী বেডে আছে, কেউ ফ্লোরে নেই। এখন পর্যন্ত মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের চিকিৎসকেরাই ডেঙ্গু রোগীদের সেবা দিচ্ছে। তবে রোগী আরো বাড়লে অন্য ডিপার্টমেন্টের চিকিৎসকেরাও ডেঙ্গু রোগীদের সার্ভিস দিবে।"
ঢাকা মেডিকেল কলেজের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, "আজ (বৃহস্পতিবার) আমাদের হাসপাতালে একেদিনে সর্বোচ্চ ৫৮ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। রোগীর চাপ বাড়ছে। তবে ডিএনসিসি হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ঘোষণা করায় আমাদের রোগীর চাপ কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।"
এদিকে ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালের পরিচালক কর্নেল এ কে এম জহিরুল হোসেন খান বলেন, "বর্তমানে আমাদের হাসপাতালে ৪২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে। ৮০০ বেডের হাসপাতালে প্রাথমিকভাবে আমরা ডেঙ্গু রোগীর জন্য ৫০০ বেড চালু করবো। আমাদের কোভিড আইসিইউ আছে, প্রয়োজনে ডেঙ্গু রোগীদের সেবা দেয়া হবে সেখানে।"