সোলার হোম প্রকল্প কেন সফল হলো না
তীব্র গরম, আর্দ্র দিন ও বিদ্যুৎবিহীন অন্ধকার রাতে আর টিকতে পারছিলেন না ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ওমান-প্রবাসী রফিকুল ইসলামের। ওই সময়ই আশপাশের কয়েকটি সচ্ছল পরিবারকে বাড়িতে কয়েকটি সোলার প্যানেল স্থাপন করতে দেখেন তিনি। ওইসব বাড়িতে গরমেও ফ্যান চলে, রাতে চলে টিভি। তা দেখে রফিকুলও ১৫ হাজার টাকা ব্যয়ে নিজের বাড়ির ছাদে ২০ ওয়াট ক্ষমতার একটি সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করেন ২০১১ সালে।
প্রথম দিকে ভালোই চলছিল সবকিছু। বেশ কিছুদিন ফ্যান, লাইট আর টিভি ঠিকমতোই চালাতে পারছিলেন রফিকুল। কিন্তু চার বছর পরই দেখা গেল, সিস্টেমের ব্যাটারি তার বাড়ির সার্কিটে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য আর চার্জ ধরে রাখতে পারছে না। ৪ হাজার টাকা ব্যয়ে ব্যাটারি বদলাতে গিয়ে রফিকুল দেখেন যাদের কাছ থেকে সিস্টেম কিনেছিলেন—উপকূলীয় বিদ্যুতায়ন ও মহিলা উন্নয়ন সমিতি—তারা অফিস গুটিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।
রফিকুলের ছেলে সাজেদুল ইসলাম রাব্বি বলেন, 'সিস্টেমটা কয়েক বছর পড়ে ছিল। অবশেষে গত বছরের জুনে বিদ্যুৎ বিভ্রাট শুরু হলে আমরা একটা নতুন ব্যাটারি কিনি।'
একই জেলার ধনিয়া ইউনিয়নের জেলে ফারুক মাঝিকেও দুইবার সোলার সিস্টেমের ব্যাটারি বদলাতে হয়েছে। তিনি ২০১০ সালে গ্রামীণ শক্তি থেকে সিস্টেমটি কিনেছিলেন।
সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক-বহির্ভূত সংস্থা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের টেস্ট রিলিফ প্রজেক্ট-এর (কাবিটা/টিআর) মাধ্যমে বিতরণ করা ৫৩.৫৭ লাখ সোলার হোম সিস্টেমের অধিকাংশেরই এখন এই অবস্থা।
উপকূলীয় বিদ্যুতায়ন ও মহিলা উন্নয়ন সমিতি এবং গ্রামীণ শক্তির মতো ৫৬টি সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে ইডকল এসব সোলার সিস্টেম বিতরণ করেছে।
স্টেকহোল্ডারদের মতে, চলমান প্রাথমিক জ্বালানি—গ্যাস, কয়লা ও তেল—সংকটের ফলে সৃষ্ট লোডশেডিংয়ের সম্ভাব্য সমাধান হতে পারত একসময় প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘর আলোকিত করার একমাত্র উৎস সোলার হোম সিস্টেম।
কিন্তু ব্যাটারি, ইনভার্টার ও সোলার প্যানেলের নিম্নমানের কারণে এই সিস্টেমগুলোর অনেকগুলোই অচল হয়ে পড়ে।
পরিবেশকরা বিক্রয়োত্তর সেবা বন্ধ করে দেওয়ায় ভোক্তারা আর তাদের সিস্টেম মেরামত করতে পারছেন না বলে জানান স্টেকহোল্ডাররা।
তবে প্রকল্পটির সঙ্গে যুক্ত জড়িত কর্মকর্তারা বলেন, গ্রাহকদের কাছ থেকে কিস্তির বকেয়া আদায় করতে না পারা, গ্রিড বিদ্যুতের প্রসারের কারণে সোলার হোম সিস্টেমের বাজারের পতন ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের নেওয়া বিনামূল্যে সোলার সিস্টেম বিতরণ তাদের কর্মসূচিগুলোকে বিপন্ন করেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, এখন প্রায় ২০ লাখ সোলার হোম সিস্টেম চালু আছে।
'দেশের যেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রিডের বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল না, সোলার হোম সিস্টেম ওই সব এলাকায় চালু করা হয়েছিল। তবে গ্রিড সম্প্রসারণের কারণে সক্রিয় সোলার সিস্টেমের সংখ্যা কমে গেছে,' বলেন তিনি।
সোলার হোম সিস্টেমের জন্য ইডকলের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনস ফর সোলাআর হোম সিস্টেম অনুসারে, ব্যাটারির ন্যূনতম আয়ুষ্কাল হওয়ার কথা পাঁচ বছর। ব্যাটারি নষ্ট হয়ে গেলে বা ওয়ারেন্টির সময়কালের মধ্যে নির্দিষ্ট মান অনুযায়ী কাজ না করলে, অংশীদার প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাটারি বদলে দেওয়ার কথা।
তবে ইডকল কর্তৃপক্ষ টিবিএসকে জানিয়েছে, গ্রাহকরা ঠিকমতো কিস্তি শোধ করতে না পারায় এই সংস্থাগুলোর জন্য স্থানীয় কার্যালয় চালু রাখা আর্থিকভাবে লাভজনক হচ্ছিল না।
একই সময়ে একাধিক সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প
ইডকল ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাংক ও গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটির কাছ থেকে পাওয়া অর্থ সহায়তা দিয়ে সোলার হোম সিস্টেম প্রকল্প শুরু করে।
পরে জার্মান উন্নয়ন সংস্থা জিআইজেড এবং তাদের বিনিয়োগ ও উন্নয়ন ব্যাংক কেএফডব্লিউ, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি, ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ও অন্যান্য অর্থায়নকারী অংশীদাররা এই কর্মসূচি সম্প্রসারণের জন্য অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে।
২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৫৬টি অংশীদার সংস্থার সহায়তায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রায় ৪১.৩ লাখ সোলার সিস্টেম বসানো হয়।
অন্যদিকে, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির অংশ হিসেবে ত্রাণ অধিদপ্তরের কাবিটা/টিআর প্রকল্পের আওতায় সরকার সোলার হোম সিস্টেম বিতরণ শুরু করেছে।
২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে এ প্রকল্পের আওতায় ১২.২১ লাখ সিস্টেম বিতরণ করা হয়েছে।
একই সময়ে সরকারের '২০২১ সালের মধ্যে শতভাগ বিদ্যুতায়ন' প্রকল্প সফল করার জন্য প্রত্যন্ত ও বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোতে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্প্রসারণ শুরু করে বিদ্যুৎ বিতরণকারী কোম্পানিগুলো।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি সমীক্ষা অনুসারে, অংশীদারদের মধ্যে নীতিগত সমন্বয় না থাকা সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর অনিশ্চিত অবস্থার একটি প্রধান কারণ।
রহিম আফরোজ কোম্পানির উদ্যোগে গঠিত রুরাল সার্ভিসেস ফাউন্ডেশন (আরএসএফ) প্রায় ৭ লাখ সোলার হোম সিস্টেম বিতরণ করেছে। ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনাওয়ার মিসবাহ মঈন বলেন, টিআর/কাবিটা প্রকল্পে বিনামূল্যে সোলার সিস্টেম বিতরণ শুরু হলে ইডকল কর্মসূচি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।
তার মতে, কাবিটা কর্মসূচিতে গুণগত মান পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ বা অংশীদার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোনো প্রশিক্ষণ না দিয়েই সোলার সিস্টেম বিতরণ করা হয়েছিল।
কাবিটা/টিআর প্রকল্পের পরিচালক মো. আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছেন।
তিনি উল্লেখ করেন, শতভাগ বিদ্যুতায়নের প্রচেষ্টায় গ্রামীণ এলাকাও গ্রিডের আওতায় আনার কারণে এই কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে।
নিম্নমানের যন্ত্রপাতি
একটি সোলার হোম সিস্টেম প্যাকেজের মধ্যে সোলার প্যানেল, ব্যাটারি, ইনভার্টার, ক্যাবলসহ অন্যান্য সরঞ্জাম থাকে। সিস্টেম বসানোর পরে গ্রাহককেই প্রতিটি সরঞ্জামের ব্যয় বহন করতে হয়।
কিন্তু দেখা গেছে, নিম্নমানের ব্যাটারি ও ইনভার্টারের কারণে বেশিরভাগ সোলার সিস্টেম এখন সমস্যার সম্মুখীন।
টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের সোলার সিস্টেম ব্যবহারকারী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, গ্রিডের সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে তাদেরকে অন্ধকারে দিন কাটাতে হচ্ছে, প্রচণ্ড গরম সহ্য করতে হচ্ছে। কারণ তাদের সোলার সিস্টেমের যন্ত্রগুলো বাতিল হয়ে গেছে। এখন সেটি প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে না।
রহিম আফরোজের পরিচালক ও অ্যাকুমুলেটর ব্যাটারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশের (এবিএমইএবি) সভাপতি মুনাওয়ার মিসবাহ মঈন বলেন, কিছু প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা নিম্নমানের ব্যাটারি বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এসব সংস্থা 'অবৈধ' বাজার থেকে এসব পণ্য সোর্স করে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
বিক্রয়োত্তর সেবা বন্ধ
২০১৩ সালের পরে বসানো বেশিরভাগ সোলার সিস্টেমই ইডকলের অংশীদার সংস্থাগুলো থেকে বিক্রয়োত্তর সেবা পায়নি।
গ্রাহকরা তাদের কিস্তির অর্থ ঠিকমতো পরিশোধ না করায় সংস্থাগুলো তাদের সবগুলো স্থানীয় অফিস বন্ধ করে দেয়।
অনেক চেষ্টা করেও উপকূলীয় বিদ্যুতায়ন ও মহিলা উন্নয়ন সমিতির কোনো বক্তব্য নিতে পারেনি টিবিএস।
গ্রামীণ শক্তির প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা মো. আবদুস সাত্তার বলেন, ভোক্তারা কিস্তি দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় স্থানীয় অফিস চালানো আর আর্থিকভাবে লাভজনক ছিল না।
তিনি বলেন, 'এখনও গ্রাহকদের কাছ থেকে ৩০০ কোটি টাকা বকেয়া আদায় করা বাকি আছে।'
'তবে আমরা ইডকল-নির্ধারিত ওয়ারেন্টির মেয়াদের মধ্যে উপযুক্ত গ্রাহকদের বিক্রয়োত্তর সেবা দিয়েছি,' বলেন তিনি।
এখনও ৮৫০ কোটি টাকা আদায় করতে পারেনি ইডকল
যেসব সংস্থা গ্রাহক বাছাই, ঋণ সম্প্রসারণ, সিস্টেম স্থাপন ও বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদানের কাজ করত, তাদেরকে অনুদান ও সহজ শর্তের ঋণসহ প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছিল ইডকল।
এই প্রকল্পের আওতায় ইডকলের মোট বিনিয়োগ প্রায় ৬৯৬ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৬০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ ও ৯৬ মিলিয়ন ডলার অনুদান।
ইডকলের তথ্যানুসারে, অংশীদার সংস্থাগুলোর মধ্যে গ্রামীণ শক্তি (৩৮.৮ শতাংশ) ও রুরাল সার্ভিসেস ফাউন্ডেশন-এর (১৪.৫ শতাংশ) গ্রাহক ছিল সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য সংস্থাগুলোর গ্রাহক প্রায় ২৫ শতাংশ।
যে পরিমাণ অর্থ দিয়েছিল তা থেকে ইডকল এখনও অংশীদার সংস্থাগুলোর কাছ থেকে প্রায় ৮৫০ কোটি টাকা আদায় করতে পারেনি বলে সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানান।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোম্পানিটি বকেয়া আদায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব নিয়ম-কানুন মেনে চলছে বলে জানান তারা।