প্রজনন মৌসুমে তালগাছের অভাবে ভালো নেই বাবুই পাখি
একসময় গ্রামগঞ্জে, এমনকি শহরতলীতেও অনেক তালগাছ দেখা যেতো; সেসব তালগাছে ঝুলে থাকতো হাওয়ায় দোদুল্যমান বাবুই পাখির বাসা। একসাথে দশটি, বিশটি বাসা ঝুলে থাকতে দেখা যেতো তালগাছগুলোতে। তবে এগুলো এখন অতীত চিত্র।
বর্তমানে না দেখা যায় তালগাছ, না দেখা যায় তালগাছে ঝুলন্ত বাবুইয়ের বাসা। শুধু তালগাছ নয়; নারকেল, সুপারিসহ নানান দীর্ঘকায় বৃক্ষেই বাসা বাঁধে বাবুই। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এসব গাছ কমে যাওয়ায় আবাসন নিয়ে চরম সংকট পড়েছে এই পাখি।
বাবুই পাখির বাসা তৈরির সাথে জড়িত এর প্রজনন প্রক্রিয়া। প্রজনন মৌসুমে নারী বাবুইকে আকৃষ্ট করতে একের পর এক বাসা তৈরি করে যায় পুরুষ বাবুই পাখি। সেসব বাসা দেখেই পুরুষ বাবুইর প্রতি আকৃষ্ট হয় নারী বাবুই পাখি। নিরাপদ আবাস নির্মাণ করার পরই একটি পুরুষ বাবুই নারী বাবুইয়ের সঙ্গে মিলিত হবার যোগ্য বলে প্রমাণিত হয়। তার ডাকে কাছে আসে স্ত্রী বাবুই পাখি। এরপর তাদের বাসায় ডিম আসে, বাচ্চা ফোটে।
সাধারণত মে থেকে আগস্টের মধ্যে বাবুই পাখির প্রজনন মৌসুম। একটি পুরুষ পাখির একাধিক বাসা ও পরিবার থাকতে পারে। স্ত্রী বাবুই সাধারণত ২ থেকে ৪টি করে ডিম দেয়। ডিম ফুটে ছানা বের হতে সময় লাগে গড়ে ১৪ থেকে ১৫ দিন। আর একটি ছানা ১৪ থেকে ১৬ দিনে নিজের মতো করে চলাফেরার সক্ষমতা অর্জন করে।
বাবুই পাখিদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে- ঘাস, বীজ, খাদ্যশস্য ও পোকা-মাকড়।
পাখিবিদ এস আই সোহেল বলেন, "বাবুই পাখি তাল, নারকেল, সুপারি, খেজুর ও বাবলা গাছে বাসা করে থাকে। তবে বাসা বাঁধার জন্য সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে তালগাছ। কিন্তু তালগাছ কেটে তাদের আবাসন আমরা ইতোমধ্যেই নষ্ট করে ফেলেছি।"
তাই এখন প্রজনন মৌসুম আসলে পুরুষ বাবুইদের ধুঁকতে হয় বাসা তৈরি নিয়ে। প্রয়োজনমতো নিরাপদ উঁচু গাছ না পাওয়ায় অনেক অনিরাপদ গাছে বাসা তৈরি করতে বাধ্য হচ্ছে বাবুই। এতে করে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বাবুইয়ের প্রজনন প্রক্রিয়া এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন জায়গায় বাবুই পাখিকে বাসা তৈরি করতে দেখা গেছে কলা গাছে, সাধারণ ঝোপঝাড়ে। আবাসন সংকটের মাঝে এসব জায়গায় বাবুই বাচ্চা জন্ম দেওয়ায় তা অনায়াসেই নিয়ে যাচ্ছে মানুষ। যার ফলে চরম অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে পড়েছে এই সময়ের বাবুই পাখি। ঝুঁকি জেনেও অনেকটা বাধ্য হয়েই যেন অনিরাপদ জায়গায় আবাস গড়ে তুলছে পাখিগুলো। ফলে নিমিষেই ঝড়ের কবলে কিংবা মানুষের হাতে মারা পড়ছে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য এম এ তাহের বলেন, "আমি এই প্রথম দেখলাম বাবুই পাখি কলা গাছের ডালে এবং কাশবনে বাসা বানাচ্ছে; আর কেউ দেখেছে কি না, আমার জানা নেই। এ থেকেই বোঝা যায় কতোটা বিপন্নতার কাতারে চলে যাচ্ছে বাবুই পাখি। প্রকৃতি না বাঁচলে মানুষ বাঁচবে কীভাবে?"
বাবুই পাখির বাসা তৈরিকে একসময় স্বনির্ভরতার প্রতীক এবং নৈতিক শিক্ষা হিসেবে বিদ্যালয়ে পাঠদান করানো হলেও বর্তমান বাস্তবতার নিরীক্ষে নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই হুমকির মুখে রয়েছে এই পাখি।
এম এ তাহের আরও জানান, বাবুই পাখি সাধারণত তিন ধরনের বাসা তৈরি করে। নিচের দিকে অনেক লম্বা সরু একটা রাস্তা থাকে, যে রাস্তা দিয়ে বাসার ভেতরে ঢোকে। এমন বাসা অনাগত ছানার জন্য নিরাপদ।
আরেক ধরনের বাসার বেশিরভাগ অংশ খোলা থাকে। এমন বাসা বানানোর পেছনের কারণ হলো, বাবুই পাখিটি এই বাসায় বিশ্রাম করে বা এখানে বসে আশেপাশে সতর্ক হয়ে পাহারা দেয়।
আরেকটি বিশেষ ধরনের বাসা বানায়, যার ভেতরে দুটি অংশ থাকে। সে বাসায় সংসার ছানাসহ বিশ্রামের আলাদা জায়গা থাকে। কিন্তু উঁচু গাছের অভাবে এখন আর চিরচেনা সেই দৃশ্যের দেখা মেলেনা বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, "অতি লোভে আমরা তাল গাছ কেটে অন্য গাছ লাগাচ্ছি। তার ওপর কিছু কুসংস্কার আছে। গ্রামের মানুষ মনে করে তাল গাছে ভুত বাসা বাঁধে। আর সে ধারণা থেকেও অনেক তালগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। জ্ঞানের অভাবে টাকার লোভে আমরা প্রকৃতি ধ্বংস করে চলেছি।"
বাংলাদেশ বার্ডক্লাবের সহ-সভাপতি তারেক অণু জানান, তালগাছ কমে যাওয়ার একটি মূল কারণ হচ্ছে মানুষের ধারণা, যে তাল গাছ লাগায় তার তিন প্রজন্ম পরে সেই গাছে তাল হয়। এ ধারণা থেকে মানুষ তালগাছ লাগায় না। অথচ বাস্তবতা হলো, মানুষ তার লাগানো গাছ থেকেই তাল খেয়ে যেতে পারে জীবদ্দশায়।
"বাবুই পাখির জন্য আমাদের তাল গাছ রক্ষা করতে হবে। প্রকৃতির এই শিক্ষককে পরবর্তী প্রজন্মের সামনে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে," যোগ করেন তিনি।