চাল রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা যেভাবে বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের সূচনা করতে পারে
বিশ্বের কয়েকশ' কোটি মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। চাল তাই অন্যতম প্রধান শস্য; কিন্তু নয়াদিল্লি চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার প্রভাব কী হবে– তারই বিশ্লেষণ করেছেন বিবিসির প্রতিবেদক সৌতিক বিশ্বাস। বিবিসি অবলম্বনে।
এর আগে দেশটি গত ২০ জুলাই বাসমতী ছাড়া অন্য সব ধরনের চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। স্থানীয় বাজারে দাম স্থিতিশীল রাখতেই এ উদ্যোগ নেয় দেশটি।
এই ঘোষণার পরই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে ভারতীয় মুদিপণ্যের দোকানগুলোয় চাল কিনতে ভোক্তারা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন এমন সংবাদ সামনে আসে। আরো দাম বৃদ্ধির আশঙ্কায়, বাড়তি পণ্য কিনে দোকানের তাকগুলো খালি করে ফেলেন তারা।
চালের হাজারো ধরনের জাত থাকলেও – বিশ্বব্যাপী আমদানি-রপ্তানি হওয়া চালকে প্রধানত চার শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এরমধ্যে সরু লম্বা দানার ইন্ডিকা রাইস বা চালের বাণিজ্যই সিংহভাগ। বিশ্ববাণিজ্যে বাকি অংশটুকু নিয়ন্ত্রণ করে – বাসমতীর মতো বিভিন্ন সুঘ্রাণযুক্ত চাল; সুশি ও রিসোট্টো খাবারের ছোট দানার জাপোনিকা, এবং মিষ্টান্ন তৈরিতে ব্যবহৃত আঠালো চাল বা স্টিকি রাইস।
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক, এ শস্যের ৪০ শতাংশ বৈশ্বিক বাণিজ্য দেশটির নিয়ন্ত্রণে। অন্যান্য শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশগুলো হলো – থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র।
চালের বৃহৎ আমদানিকারকদের মধ্যে আছে চীন, ফিলিপাইন ও নাইজেরিয়া। এছাড়া, স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বা সরবরাহে কোনো ঘাটতি হলে, প্রয়োজন অনুসারে কেনে এমন দেশের মধ্যে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ।
এশিয়ার পাশাপাশি আফ্রিকাতেও প্রচুর পরিমাণ ভাত খাওয়া হয়, এবং তার পরিমাণ দিনে দিনে বাড়ছে। কিউবা ও পানামার মতো ক্যারিবিয় দেশে ক্যালোরির প্রধান উৎস- ভাত।
গত বছর বিশ্বের ১৪০টি দেশে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ টন চাল রপ্তানি করে ভারত। এরমধ্যে, ৬০ লাখ টনই ছিল তুলনামূলক দামে সস্তা ইন্ডিকা হোয়াইট রাইস।
একটি হিসাবমতে, গত বছর চালের বৈশ্বিক বাণিজ্য ছিল প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ টন। এর ৭০ শতাংশ বাণিজ্য হয় ইন্ডিকা হোয়াইট চালের। সেই চালই এবার রপ্তানি বন্ধ করেছে ভারত। গত বছর ভারত খুদ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়, এবং বাসমতী নয় এমন সাদা চাল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্কারোপ করে, তার সাথে নতুন শঙ্কার সৃষ্টি করেছে সাম্প্রতিক ঘোষণা।
এর ফলে বিশ্ববাজারে চালের মূল্য লাগামহীন গতিতে বেড়ে যাওয়ার উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ পিয়েরে- অলিভার গুরিনচাস মনে করেন, এ নিষেধাজ্ঞার ফলে বাজারে চালের দাম বেড়ে যাবে। চলতি বছরে খাদ্যশস্যের বৈশ্বিক দাম ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
তাছাড়া, অনুকূল বৈশ্বিক পরিস্থিতির মধ্যে আসেনি এই নিষেধাজ্ঞা – এমন মন্তব্য করেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ইউএন ফাও) চাল-বাজার বিশ্লেষক শার্লি মোস্তফা।
ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, প্রথমত ২০২২ সালের শুরু থেকেই চালের দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়তে দেখা যাচ্ছে। গত জুনের পর থেকে যা বেড়েছে ১৪ শতাংশ। দ্বিতীয়ত, সরবরাহ ব্যবস্থাও প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আছে। এই অবস্থায়, নতুন ফসল বাজারে আসতেও আরো তিন মাস লাগবে।
ভারতে খামখেয়ালি আবহাওয়া – মৌসুমি বৃষ্টিপাতের অসম অবস্থা এবং পাকিস্তানে ভয়াল বন্যা – বৈশ্বিক সরবরাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। একইসঙ্গে, সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ধান উৎপাদনের খরচও অনেকটাই বেড়েছে। ফলে ধান আবাদে নিরুৎসাহিত হয়েছে চাষিরা।
সেইসঙ্গে মার্কিন ডলার শক্তিশালী হওয়ায় – তার বিপরীতে অনেক দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে। এতে দেশগুলোর আমদানি ব্যয় বহুগুণ বেড়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাণিজ্যের জন্য ঋণ নেওয়ার খরচও বাড়িয়েছে।
শার্লি মোস্তফা বলেন, 'আমদানিকারকদের সক্ষমতা কমার মতো পরিস্থিতি আমরা লক্ষ করছি। এই অবস্থায়, ক্রেতা দেশগুলো আরো মূল্যবৃদ্ধির সাথে তাল মেলানোর অবস্থায় থাকবে কিনা– সেটাই দেখার বিষয়।'
এদিকে ভারতের কাছে বিপুল পরিমাণ বা প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ টন চালের মজুত রয়েছে। যা দেশটির বাফার বা আপৎকালীন মজুত সক্ষমতার চেয়েও বেশি। এর বেশিরভাগই সরকারি গুদামগুলোয় কৌশলগত মজুত হিসেবে রয়েছে। দেশটির সরকারি বিতরণ ব্যবস্থা– এই মজুত থেকে ৭০ কোটি দরিদ্র মানুষের জন্য সস্তায় চাল সরবরাহ করে।
তা সত্ত্বেও গত এক বছর ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে ভারতের জনগণকে। গত বছরের অক্টোবরের পর থেকে স্থানীয় বাজারে চালের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। এদিকে আগামী বছরেই দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন, তার আগে খাদ্যদ্রব্যের দাম কমানোর রাজনৈতিক চাপ রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর। আগামী কয়েক মাসে কয়েকটি রাজ্য-পর্যায়ের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে। এরমধ্যে জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধি সরকারের জন্য এক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই বা ইফপ্রি) বিশেষজ্ঞ জোসেফ গ্লবার বলেন, 'আমার সন্দেহ, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে বাসমতী ছাড়া অন্যান্য সাদা চাল রপ্তানিতে এ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, আশা করি এটি সাময়িক হবে।'
তার সাথে একমত পোষণ করেন ভারতের কৃষি নীতি বিশেষজ্ঞ দ্বেবিন্দার শর্মা। তিনি বলেন, উৎপাদনে সম্ভাব্য ঘাটতির অনুমান করেই আগে থেকে সরকার এ ব্যবস্থা নিয়েছে। কারণ এল নিনো জলবায়ু পরিস্থিতির কারণে এই বছরে দক্ষিণ ভারতের চাল উৎপাদক অঞ্চলে অনাবৃষ্টির ঝুঁকি রয়েছে।
বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভারতের অপরিহার্য ভুমিকার কারণে দেশটির চাল রপ্তানিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া উচিত নয় বলেই অনেকে মনে করেন।
ইফপ্রির তথ্যমতে, ৪২টি দেশের আমদানিকৃত চালের অর্ধেকই করা হয় ভারত থেকে। আফ্রিকার কিছু দেশ তাদের চাহিদার ৮০ শতাংশ ভারত থেকে আমদানি করে।
এশিয়ায় ভাত প্রধান খাদ্য, এমন শীর্ষ কয়েকটি দেশ – বাংলাদেশ, ভুটান, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার অধিবাসীরা দৈনিক যে পরিমাণ ক্যালোরি গ্রহণ করেন – তার ৪০ থেকে ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত আসে ভাত থেকে।
শার্লি মোস্তফা বলেন, এই নিষেধাজ্ঞায় বিশ্বের দরিদ্র, ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী আরও দুর্ভোগ পড়ল, কারণ তাদের আয়ের সিংহভাগই খাবার কিনতে ব্যয় হয়। দাম বাড়লে, তারা খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ কমাতে বাধ্য হবে, বা আরও কম পুষ্টিকর বিকল্প এমন খাদ্যের দিকে ঝুঁকবে। বাসস্থান, চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদার পেছনেও হয়তো তারা ব্যয় কমাবেন। (তবে ভারতের নিষেধাজ্ঞার আওতায়, খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা দেশে কিছু পরিমাণ চালান পাঠানোর অনুমতি আছে)।
খাদ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা নতুন কিছু নয়। গত বছর ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকে খাদ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া দেশের সংখ্যা তিনটি থেকে বেড়ে ১৬টিতে উন্নীত হয়েছে বলে জানায় ইফপ্রি। যেমন ইন্দোনেশিয়া পাম তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়; আর্জেন্টিনা দেয় গোমাংস রপ্তানিতে; আবার তুরস্ক ও কিরগিজিস্তান নানান ধরনের শস্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। করোনা বিশ্বমারির প্রথম চার সপ্তাহে ২১টি দেশ বিবিধ পণ্য রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করে।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞায় খাদ্য নিরাপত্তার অনেক বড় হুমকি।
দিল্লি-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান- ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক রিলেশন্স- এর বিশেষজ্ঞ অশোক গুলাটি ও রায়া দাস বলেন, এই নিষেধাজ্ঞায় বিশ্ববাজারে সাদা চালের দাম নিশ্চিতভাবেই বাড়বে। এতে আফ্রিকার অনেক দরিদ্র দেশে খাদ্য নিরাপত্তা বিপন্ন হবে।
তারা মনে করেন, 'জি-২০'তে বৈশ্বিক দক্ষিণের দায়িত্বশীল নেতা হতে হলে, ভারতকে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে চলতে হবে।' আর তা নাহলে, অন্য দেশগুলো ভারতকে চাল সংগ্রহের নির্ভরযোগ্য উৎস বলে মনে করবে না।