ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প কি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন? দণ্ডিত হলে কী হবে?
বিশ্ব ইতিহাসে ইতিবাচক হোক বা নেতিবাচক, বহু দৃষ্টান্ত রেখেছে আমেরিকা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)। বলা হয়, আমেরিকার ইতিহাস নজির স্থাপনেরই। কিন্তু, প্রেসিডেন্ট থাকার সময় সকল ঐতিহ্য ও প্রথা ভেঙে ডোনাল্ড ট্রাম্পও বিতর্কিত দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন।
এতকিছুর পরেও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি আবারো প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে পারবেন কিনা; বা নির্বাচিত হলে দ্বিতীয়বারের মতো হোয়াইট হাউসে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন কিনা – ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক মহলে সে আলোচনাই এখন সরগরম।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের যে তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছে– সেসব মামলার ভবিষ্যৎ নিয়েও রাজনীতির মাঠে গুঞ্জনের শেষ নেই।
এই বাস্তবতায়, মামলা চলমান থাকার পরেও ট্রাম্প কি আবারো ভোটে জিতে ফিরতে পারবেন হোয়াইট হাউসে? – সে প্রশ্নের উত্তর জানতে এক শতাব্দী আগের এক দৃষ্টান্ত জেনে নেই চলুন।
১৯২০ সালে নির্বাচনে কারাগারে থেকেই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছিলেন ইউজিন ডেবস। তিনি ছিলেন, সোশ্যালিস্ট পার্টি অব আমেরিকার সদস্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভুমিকা নিয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্য প্রচার করায় ১৯১৭ সনের গুপ্তচর আইনভঙ্গের দায়ে তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। নির্বাচনে ডেবস মাত্র ১০ লাখ ভোট পান। অন্যদিকে, বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন রিপাবলিকান দলের ওয়ারেন হার্ডিং।
অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ট্রাম্পকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অধিকার দেয়। ফেডারেল আইনে দোষী সাব্যস্ত হলেও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনে তা বাধা দেয় না। এমনকী কারাগারে থাকলেও। তবে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি রাষ্ট্রদ্রোহের মতোন নির্দিষ্ট অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন – তাহলে আর প্রার্থী হতে পারবেন না।
এমন বাস্তবতায়, ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি মার্কিন পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিলে তাঁর সমর্থকদের হামলার পেছনে ট্রাম্পের ভূমিকা উচ্চমার্গের তর্কের খোরাক হতেই পারে। কিন্তু, আইনি বর্ণনায়, সেই (বিদ্রোহের) সম্ভাবনাকে নাকচ করা হয়েছে: বর্তমানে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দায়ের করা তিনটি ফৌজদারি মামলার কোনোটিতেই তাকে এই অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়নি।
তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম ফৌজদারি মামলা ছিল অর্থ সংক্রান্ত। পর্ণতারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের সাথে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ছিল ট্রাম্পের। স্টর্মির দাবি, মুখ বন্ধ রাখতে গোপনে তাকে অর্থ দেন ট্রাম্প। আর সেটা গোপন রাখতে ট্রাম্পের ব্যবসায়িক লেনদেনের রেকর্ডে মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়। নিউইয়র্কে ম্যানহাটনের আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে এজন্য মামলা করা হয়। কিন্তু, এই মামলায় তিনি যেজন্য অভিযুক্ত তা ফেডারেল অপরাধ বলে গণ্য নয়। ফলে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ স্বাভাবিকভাবেই এ মামলায় আনা হয়নি।
অন্য দুটি অভিযোগ আনা হয়েছে ফেডারেল আদালতে। এরমধ্যে দ্বিতীয়টিতে তার বিরুদ্ধে গোপনীয় দলিলপত্র নিজের কাছে রাখা এবং এর তদন্তে বাধা সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। আর সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে ফেডারেল আদালতে ট্রাম্প ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল উল্টে দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিলেন এমন অভিযোগ আনা হয়। ক্যাপিটলে হামলার পেছনে তিনিই যে উস্কানিদাতা ছিলেন- সেই ভূমিকা এর মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়ায় জোর ভিত্তি পেয়েছে।
এবার ওয়াশিংটনের ফেডারেল আদালতের গ্রান্ড জুরি তাঁর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রবঞ্চনা, সরকারি কাজে বাধা দানের চেষ্টা, এবং নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রয়োগ ও ভোট গণনায় বাধা দেওয়ার চক্রান্তের অভিযোগ এনেছেন।
কিন্তু, বিচার বিভাগের নিয়োগ দেওয়া বিশেষ কনসাল জ্যাক স্মিথ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যে ৩৭টি অপরাধের বর্ণনা করেছেন, তাঁর মধ্যে 'বিদ্রোহের' উল্লেখ নেই।
হোয়াইট হাউস থেকে সরকারি অনেক গোপন নথি ট্রাম্প ফ্লোরিডায় তাঁর বিলাসবহুল ম্যানশন মার - এ- লাগোয় এনে রাখায় তাঁর বিরুদ্ধে ৩১ বার গুপ্তচর আইনভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছে। আরো ৩টি অভিযোগ আনা হয়েছে, তদন্তকারীদের থেকে এসব নথি লুকিয়ে রাখার জন্য; আর দুটি অভিযোগ, তাঁর কাছে রাষ্ট্রীয় কোনো নথি নেই- এমন মিথ্যাচারের জন্য।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নিজের এক কর্মচারীর সহযোগিতা নিয়ে বিচার ব্যাহত করার সর্বশেষ অভিযোগটি আনা হয়েছে।
আইনজীবীরা জানান, মার- এ- লাগোর একজন কর্মচারী ওয়াল্ট নাউটা ট্রাম্পের নির্দেশে ম্যানশনের এক স্থান থেকে অন্যত্র এসব গোপন নথি আনা-নেওয়া করেন। এই কাজের প্রমাণ নষ্ট করতে, ম্যানশনের সিসিটিভি ফুটেজ মুছে ফেলা হয়।
রাষ্ট্রদ্রোহী যেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ না নিতে পারেন, এমন বিধান রাখার আলোচনা রয়েছে মার্কিন সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীতে।
১৮৬৮ সনে পাস হওয়া ওই সংশোধনীতে- যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী বা সেদেশে বেড়ে ওঠা সকলকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। দাস-সহ সকলের জন্য সম-অধিকারের ঘোষণাও রয়েছে এতে। একইভাবে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী কোনো সামরিক, বেসামরিক বা নির্বাচিত পদের অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না এই নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হয়। তবে মার্কিন পার্লামেন্টের উচ্চ ও নিম্নকক্ষ – সিনেট ও কংগ্রেস যদি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তাকে সমর্থন দেয়- তাহলে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না।
রাজনৈতিক মতবিরোধে গভীরভাবে বিভাজিত যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান বাস্তবতায়, কারো পক্ষে এই ধরনের নিরঙ্কুশ সমর্থন লাভ বলতে গেলে অসম্ভব।
সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সময় মার্কিন বিচার বিভাগের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ও বর্তমানে নিউইয়র্কের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী কেভিন ও'ব্রায়ান বলেন, 'আমেরিকার গৃহযুদ্ধের কিছু সময় পরেই এই সংশোধনীর খসড়া প্রস্তুত করা হয়, এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিদ্রোহী কনফেডারেটদের আইনিভাবে চিহ্নিত করা যারা আব্রাহাম লিংকনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল।'
শিষ্টাচার বিধি
ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়য়ের মিলার সেন্টার ফর প্রেসিডেন্সিয়াল ওরাল হিস্টোরিজের সহ-পরিচালক ঐতিহাসিক রাসেল এল. রাইলির মতে, রিপাবলিকান দলের প্রাইমারিতে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তাই বেশি। প্রাইমারিতে জিতলে তিনিই জো বাইডেনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নির্বাচনে লড়বেন, এক্ষেত্রে তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় আইনি কোনো বাধা নেই।
'কিন্তু, এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে সেটা কেউ আগে বুঝতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্রের আগের প্রেসিডেন্টরা এই পদে থাকার সময় যেসব শিষ্টাচার ও বিধি মেনে চলতেন– নিজ আচরণের মাধ্যমে তাঁর প্রায় সবগুলোই ভঙ্গ করেন ট্রাম্প।'
অর্থাৎ, ট্রাম্পকে নির্বাচনে অংশ নেওয়া ঠেকাতে আইনি প্রক্রিয়া আরো জোরালো হতেও পারে এমন ইঙ্গিত দেন তিনি।
১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বিল ক্লিনটনের প্রশাসনে শ্রমমন্ত্রী থাকা রাজনৈতিক বিশ্লেষক রবার্ট রেইখ সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা করেছে এমন ব্যক্তি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না।
মার্কিন পার্লামেন্টের উভয় দলের আইনপ্রণেতাদের নিয়ে গঠিত দ্বিপক্ষীয় একটি কমিটি ১৮ মাস ধরে ক্যাপিটল হিলে হামলার তদন্ত করেছে। কমিটির সদস্যরা ১ হাজারের বেশি প্রত্যক্ষদর্শীকে জেরা করেন। এর ভিত্তিতে, তারা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিদ্রোহসহ চারটি অভিযোগ আনার প্রস্তাব করেন। তিনি যেন আর সরকারি কোনো পদে অধিষ্ঠিত না হতে পারেন, সেই প্রস্তাবও করেন তারা।