অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা অনেক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ পরিকল্পনায় বাধা হয়ে উঠেছে
করোনা মহামারির লকডাউনের মধ্যে যখন বিশ্বের বেশিরভাগ অর্থনীতি ছিল পতনের দিকে, তখনও বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় বাংলাদেশি কোম্পানি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেয়।
কিন্তু, এখন দেশ ও বিদেশ– দুই দিকেই পরিস্থিতি তাদের জন্য বেশ প্রতিকূল। অব্যাহত ডলার সংকট, দেশে জ্বালানির উচ্চ দাম এবং বিদেশে চাহিদা কমে যাওয়ার মতো নানান ঘটনা তাদের নিরুৎসাহিত করছে। এতে তারা নতুন বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়ে দেরি করতে বাধ্য হচ্ছে।
উচ্চাকাঙ্ক্ষী সম্প্রসারণ পরিকল্পনা নিয়ে মুশকিলে পড়া এমনই একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ।
গ্রুপটি তাদের কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চলে – ইস্পাত ও ফ্লোট গ্লাসের দুইটি নতুন মিল স্থাপনে ৭ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা করে।
দুটি কারখানার ভৌতকাজের জন্য এরমধ্যেই প্রায় এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে মেঘনা গ্রুপ, এখন সেসব ব্যাংক ঋণের সুদ দিচ্ছে।
ডলার সংকটের কারণে কারাখানা দুটির দরকারি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পারায় উদ্বেগজনক এক বিড়ম্বনায় আটকা পড়েছেন মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল।
কামাল বলেন, 'গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ পেতেও আমরা সমস্যার মুখে পড়েছি, এতে ৭০০ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্পগুলো আটকে রয়েছে।'
শুধু নতুন বিনিয়োগে বাধা নয়, পাশাপাশি উৎপাদনের খরচও বাড়াচ্ছে এমন ছয়টি কারণ উল্লেখ করেছেন শিল্পের অভ্যন্তরীণরা। এতে পণ্যের দামের দিক থেকে তারা বৈশ্বিক প্রতিযোগিদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছেন।
তারা ব্যাখ্যা করেন যে, অব্যাহত ডলার সংকটের পাশাপাশি, জ্বালানির আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি, সরবরাহ ব্যাহত হওয়া, স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা– সব মিলে বিশ্ববাজারে চাহিদা হ্রাসের এই সময়ে স্থানীয় শিল্পের জন্য অনিশ্চয়তার এক আবহ তৈরি করেছে।
যেসব প্রতিষ্ঠান মূলত স্থানীয় বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদন করে তারা প্রায় দুই অংকের কাছাকাছি যাওয়া মূলস্ফীতির চ্যালেঞ্জে রয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তারা ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছেন, এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিক্রিবাট্টা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য উৎপাদক- সিটি গ্রুপও একই নৌকার যাত্রী। ডলার সংকটের কারণে নতুন ইউনিটগুলোয় বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে তাদের। যেমন মুন্সিগঞ্জে গ্রুপের নিজস্ব অর্থনৈতিক অঞ্চলে একটি সিমেন্ট ও একটি কাগজের কল স্থাপনের পরিকল্পনা পেছাতে হয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত কর্তৃপক্ষ বেজার সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং সিটি গ্রুপের একজন উপদেষ্টা পবন চৌধুরী আক্ষেপ করে বলেন, 'অর্থনীতি দুর্ভোগে আছে… সব খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেউই রক্ষা পাচ্ছে না।'
যন্ত্রপাতি আমদানিতে দেরির উৎপাতে পড়েছে বসুন্ধরা গ্রুপের ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার স্বর্ণ রিফাইনারি স্থাপনের উদ্যোগ। চলতি বছর বা ২০২৩ সালের মার্চে এর উদ্বোধনের কথা থাকলেও, সেই তারিখ আরো পেছানো হয়েছে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান গ্রুপের একজন জেষ্ঠ কর্মকর্তা।
এভাবে সুতাকল থেকে শুরু করে পোশাক, সিমেন্ট, ইস্পাত প্রস্তুতকারক প্রায় সব ব্যবসা, দেশের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীই হোক বা স্বতন্ত্র ব্যবসা– দুই বছর আগে যারা নতুন বিনিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছিল– তারা সবাই এখন একই কাহিনি শোনাচ্ছে।
ডলার ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি যেভাবে শিল্পগুলোকে ভোগাচ্ছে
শীর্ষস্থানীয় পোশাক-প্রস্তুতকারক নোমান গ্রুপ তাদের নতুন তিনটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি স্থাপনে বিনিয়োগের পরিকল্পনা স্থগিত রেখেছে। বর্তমানে ৩২টি ইউনিটে নোমান গ্রুপের কর্মী সংখ্যা ৮০ হাজার। কারখানা তিনটি চালু হলে আরো ১৫ হাজার জনের কর্মসংস্থান হতো।
গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম টিবিএসকে জানান, শুধুমাত্র তার গ্রুপের গ্যাস বিল প্রতি মাসে ৮০ কোটি টাকা বেড়ে ১২০ কোটি টাকা হয়েছে।
এই পোশাক রপ্তানিকারক বলেন, প্রতি কিলোগ্রাম সুতা উৎপাদনে খরচ বেড়েছে প্রায় ৪০ সেন্ট। কিন্তু, চীন, ভারত, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া থেকে কম দামে কেনার সুযোগ থাকায় বায়াররা বেশি দাম দিচ্ছে না।
নুরুল ইসলাম বলেন, মুল্য পরিশোধে ডিলার ব্যাংক নয় মাস সময় নেওয়ায় আমদানি করা তুলার একটি চালানে গ্রুপের কারখানাগুলো ৯০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। কারণ ততোদিনে ৮৫ টাকা থেকে ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায় ডলারের দর।
এমবি নিট বর্তমানে তাদের অর্ধেক সক্ষমতায় পরিচালিত হচ্ছে। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'গ্যাস সংকট তীব্রভাবে অনুভুত হচ্ছে, অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো দীর্ঘস্থায়ী আন্তর্জাতিক অস্থিতিশীলতা সবাইকে আরো সতর্ক করে তুলেছে।'
বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ)-র সভাপতি হাতেম বলেন, দাম ১২ টাকা থেকে আকস্মিকভাবে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করায় গ্যাস সংকট আরো তীব্র হয়েছে, এটি একটি বড় উদ্বেগ, অন্যদিকে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের নিশ্চয়তাও পূরণ করা হয়নি।
এদিকে অর্ডার ঘাটতি ও এলসি নিয়ে ব্যাংকগুলোর জটিল প্রক্রিয়ার কারণে অ্যাডাম অ্যাপারেলসের কিছু ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে। এমনটাই জানান এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শহীদুল হক মুকুল। ভবিষ্যতেও তেমন আশার আলো দেখছেন না তিনি।
মোশাররফ কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশাররফ হোসেন, এই শিল্পের বর্তমান দুর্গতির জন্য গ্যাসের অসহনীয় মূল্য, সরবরাহে সংকট ও অর্ডারের সীমাবদ্ধতার কথাই উল্লেখ করেন।
#তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোও সংগ্রাম করছে
ম্যাকসন গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান মেট্রো স্পিনিং – ২০২১ সালে তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে প্রায় ২০০ কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়।
ইতোমধ্যেই কেটে গেছে ২০২৩ সালের অর্ধেক সময়। কেবলমাত্র এখন এসে তুলা থেকে সুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খুলতে পেরেছে বলে জানান কোম্পানি সচিব মো. জুয়েল রানা।
নতুন বিনিয়োগ যারা করেছে, তারাও সমস্যার মধ্যে আছে।
ডলারের সংকট যখন দেখা দেয়নি, সেই ২০২১ সালে দেশবন্ধু গ্রুপ খাদ্য ও পানীয়, প্যাকেজিং, পোশাক এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগ করে।
গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান বলেন, 'আমরা সম্প্রসারণের জন্য বিনিয়োগ করেছি। কিন্তু পূর্ণ সক্ষমতায় কাজ করতে পারছি না। আমরা অনেকেই ব্যাংক ঋণ নিয়ে সমস্যায় আছি।'
২০২২ সালের মার্চে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত কোম্পানি- মোজাফফর হোসেন স্পিনিং মিলস – ৭০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে দ্বিতীয় পর্যায়ের সম্প্রসারণের ঘোষণা দেয়।
কোম্পানি সচিব হারিস আলম টিবিএসকে বলেন, বিশ্ববাজারে মন্দাভাব ও ডলার সংকটের কারণে আমরা এই প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি করছি।
বিদ্যমান ইউনিটগুলোর আধুনিকায়ন এবং নতুন একটি ফ্যাব্রিক ইউনিট স্থাপনে – ৮৫.৪৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে– প্যারামাউন্ট টেক্সটাইল লিমিটেড অন্তত ছয় মাস দেরি করবে বলে জানান কোম্পানির এক কর্মকর্তা।
সমস্যার সুত্রপাত যখন
করোনা মহামারি সত্বেও, সফল গণটিকা কর্মসূচির সুবাদে অর্থনীতি ও জীবনযাপন সচল রাখতে পারায় – ২০২০ ও ২০২১ সাল– প্রায় দুই বছর অপেক্ষাকৃত ভালো সময় পার করে বাংলাদেশ। যখন বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই লকডাউনের মধ্যে ছিল।
কিন্তু, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাধার পর থেকেই একের পর এক সংকট দেখা দিতে থাকে। পণ্যদ্রব্য, কাঁচামালের দাম হয় আকাশছোঁয়া, আমদানি ও ভর্তুকির ব্যয় বাড়ে, এবং টাকার দ্রুত অবমূল্যায়নের পাশাপাশি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ক্ষয় দেখা দেয়।
এসময় ব্যাংকগুলো আমদানির এলসি খুলতে দেরি করা শুরু করে, এতে ব্যবসাবাণিজ্য ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়।
গত বছর ডলারের বিপরীতে টাকার ২৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ৮৫.৮০ টাকার বদলে ডিসেম্বর নাগাদ এক ডলারের দর দাঁড়ায় ১০৭ টাকা। আর চলতি আগস্ট মাসেই ডলারের দাম ১১০ টাকার বেশি হয়েছে। ফলে কাঁচামাল আমদানিতে সমস্যার মধ্যে পড়ছেন উদ্যোক্তারা। এলসি খুলতেও ডলার সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
উত্তরণের কোনো পথ আছে কি?
এই বছরের শুরুর দিকে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পূর্বাভাস দেয় যে, এ বছরের মাঝামাঝি বা তৃতীয় প্রান্তিকে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। কিন্তু তৃতীয় প্রান্তিক শেষ হতে আর মাত্র এক মাস বাকি, এরমধ্যে চ্যালেঞ্জগুলি অপরিবর্তিত অবস্থায় বা আগের তুলনায় আরও জটিল হয়েছে।
আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রতি মাসে আমদানি ব্যয় ৮ বিলিয়ন ডলার হলেও, গত ৭-৮ মাস ধরে তা ৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে রয়েছে। এরপরেও ডলারের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ঘাটতি থাকায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আমদানি ব্যয় মেটাতে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।
শীর্ষ একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, 'ডলারের জোগান পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না, যা খুবই চিন্তার বিষয়।'
ওই কর্মকর্তা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বদলে ডলারের দর নির্ধারণের ক্ষমতা বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েও কাজ হয়নি, এটাও একটা উদ্বেগজনক ঘটনা।
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে টিবিএসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউনিলিভার বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাভেদ আখতার আভাস দেন যে, ইউরোপে অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়ায় এবং চীনে প্রতিকূল অবস্থা বিরাজ করায়– বিশ্ববাজারে চাহিদা কমতে পারে। এসব কারণে ২০২৩ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে এসে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।