দৈত্যাকার বৈলাম: বিলুপ্তির হুমকিতে দেশের সবচেয়ে উঁচু গাছ
বৈজ্ঞানিক নাম অ্যানিসোপটেরা স্কেপুলা। স্থানীয়ভাবে পরিচিত বৈলাম গাছ হিসেবে। দেশের সবচেয়ে উঁচু এই বৃক্ষ ২০০ ফুটের বেশি লম্বা হয় অর্থাৎ ২০ থেকে ৩০ তলা ভবনের উচ্চতার সমান। তবে বছরের পর বছর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং বাসস্থান তৈরির জন্য নিধনের ফলে বাংলাদেশে বৈলাম গাছ এখন বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেসের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজারে এখন কেবল ৪০-৪৫টি পরিণত বৈলাম গাছ অবশিষ্ট আছে।
৩০ বছর আগেও এসব অঞ্চলে বৈলাম গাছ ছিল একটি পরিচিত দৃশ্য। তবে মানুষের বসবাসের জন্য বিপুল পরিমাণ গাছ কাটা হয়েছে। মিয়ানমার থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে প্রবেশের পরও বৈলাম গাছ নিধন হয়েছে।
বাংলাদেশ বন গবেষণা ইন্সটিটিউটের পরিচালক ড. রফিক হায়দার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, অপরিকল্পিতভাবে বন জ্বালিয়ে কৃষি কাজে ব্যবহারের কারণেও গাছের অস্তিত্ব হুমকিতে পড়েছে।
পাশাপাশি, বৈলাম গাছের ফুলের জীবনচক্র ৩০ বছরের হওয়ায় এবং কাঠ সংগ্রহের জন্য উপযুক্ত হতে ৫০ বছর সময় লাগায় স্থানীয়রাও এই গাছ সংরক্ষণে উদাসীন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আতিকুর রহমান উল্লেখ করেছেন, বৈলাম গাছের প্রাকৃতিক পুনর্জন্ম দুর্বল। তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবেই, এর প্রজনন সীমাবদ্ধ। গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি না পাওয়ায় বাংলাদেশে এটি বিপন্ন হওয়ার পথে।
একই কারণে গাছটি মালয়েশিয়া, লাওস, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামের অন্যান্য আবাসস্থলে একই রকম বিপদের সম্মুখীন বলে জানান আতিকুর রহমান। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার ২০১৭ সালে বৈলাম গাছকে গুরুতরভাবে বিপন্ন হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছে।
আতিকুর উল্লেখ করেন, বৈলাম কাঠ লম্বা এবং একই সাথে হালকা হওয়ার কারণে এর উচ্চ চাহিদা ছিল। কক্সবাজারে নৌকা তৈরির জন্য এই গাছ একসময় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত। মানুষজন কাঠের জন্য নির্বিচারে বৈলাম গাছ কাটার কারণে এই বৃক্ষের সংখ্যা কমতে থাকে।
পরিবেশগত প্রভাব
বিশেষজ্ঞদের মতে বৈলাম গাছ ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে এবং বাৎসরিক গড়ে ২,০০০-৩,০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত গাছটির জন্য উপকারী।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের জলবায়ু তথ্য উদ্ধৃত করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেসের বৈলাম বিষয়ক প্রধান গবেষক অধ্যাপক মোঃ আখতার হোসেন বলেন, গাছের প্রাথমিক আবাসস্থল কক্সবাজার অঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত গত তিন দশকে প্রায় ২৩৪ মিলিমিটার কমেছে।
একইভাবে, গত ৪০ বছরে গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা প্রায় ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে, তিনি যোগ করেন।
বিশ্বব্যাংকের 'হটার অ্যান্ড মোর হিউমিড উইথ ইরেটিক রেইনফল' সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৮০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ০.৫. ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। যেখানে চট্টগ্রামে বেড়েছে ০.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গবেষকরা বলেন, এই পরিবেশগত পরিবর্তনগুলি নির্দেশ করে যে, গত ৪০ বছরে জলবায়ু ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে যা বৈলামে সংখ্যা কমাতে প্রভাব ফেলেছে।
ফুল ফোটার সময়ের উপর প্রভাব
২০২০ সালে প্রকাশিত 'ফেনোলজিকাল ট্রেইটস অব রিকালসিট্রেন্ট সিড-বেয়ারিং ট্রিস ইন বাংলাদেশ' নামক গবেষণা অনুযায়ী, বৈলাম গাছে ফুল ফোটার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় মার্চ-এপ্রিল। আর বীজ সংগ্রহের সময় এপ্রিল থেকে মে।
তবে গাছ রোপণের জন্য উপযুক্ত এপ্রিল ও মে মাসে বাংলাদেশে এখন তাপপ্রবাহ দেখা যায় এবং বৃষ্টিপাতও কম হয়।
অধ্যাপক আখতার হোসেন বলেন, বৈলামের আবাসস্থল একটি 'মাইক্রো-ক্লাইমেট চেঞ্জ' এর সম্মুখীন হচ্ছে। যার ফলে বীজের অঙ্কুরোদগম ব্যাহত হচ্ছে এবং এর চারা টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, দেশে খুব কম মাতৃগাছ বাকি আছে, যেগুলো আবার বেশি বয়স্ক এবং বীজহীন। বাকিগুলোর বীজ চক্র অনিয়মিত এবং চারা টিকে থাকার হারও কম।
অধিকন্তু, গাছটির পরিপক্কতার জন্য কমপক্ষে পঞ্চাশ বছর প্রয়োজন এবং সে কারণেই মানুষ কাঠের জন্য বৈলাম রোপণে আগ্রহী নয়।
মানুষ বনের ঝোপ পরিষ্কার ও আবর্জনা অপসারণ করার কারণে বৈলামের দুর্বল প্রজননের আরো এক কারণ। কেননা ফল পাকার সময়কালে বন পরিষ্কার করার ফলে বীজ অঙ্কুরিত হয় না।
রক্ষার প্রচেষ্টা
বৈলামের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কৃত্রিমভাবে চারা তৈরি ও পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি জনসচেতনতার পরামর্শ দেন অধ্যাপক আখতার হোসেন।
বনে এই অতি বিপন্ন গাছটির বিস্তৃতিতে আখতার হোসেনের নেতৃত্বে একটি দল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের প্রথম জার্মপ্লাজম উদ্ভাবন করে ।
বৈলাম গাছের জিন সংরক্ষণের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লোর জার্মপ্লাজমে শত শত বৈলাম চারা রোপণ করা হয়েছে। দুই বছরে ইনস্টিটিউটের নার্সারিতে প্রায় ১০ হাজার বৈলামের চারা উৎপাদন করা হয়েছে।
বন বিভাগ ও বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন বনাঞ্চলে প্রায় ৮ হাজার চারা রোপণ করা হয়েছে।
আগামী ১০-২০ বছরের মধ্যে গাছ পরিপক্ক হয়ে ফুল ও বীজ উৎপাদন শুরু করলে প্রজাতিটি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন অধ্যাপক আখতার হোসেন।
বৈলাম সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল ব্লকের নামকরণ করা হয়েছে গাছটির নামে।