ব্রিকস সম্মেলনের আগে চীনের নেতৃত্বাধীন ‘ডি-ডলারাইজেশন’ গুরুত্ব পাচ্ছে
ডাচ বহুজাতিক ব্যাংকিং আইএনজি-র গবেষণায় উঠে এসেছে, চীনের নেতৃত্বাধীন ব্লকের সম্প্রসারণের ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আগামী সপ্তাহে অনুষ্ঠিতব্য ব্রিকস সম্মেলনের আগে এ গবেষণার তথ্য সামনে এল।
পাঁচ উদীয়মান অর্থনীতি—ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনৈতিক জোট ব্রিকস। এ ব্লকে পৃথিবীর প্রায় ৪২ শতাংশ মানুষের বাস।
ডাচ ব্যাংক আইএনজির বিশ্লেষক ক্রিস টার্নার, দিমিত্রি দলগিন ও জেমস উইলসন লিখেছেন, 'আমাদের ধারণা, আগামী সপ্তাহে ব্রিকস জোটের সিনিয়র নেতারা যখন মিলিত হবে, তখন "ডি-ডলারাইজেশন"-এর [ডলারমুক্তকরণ] বিষয়টি গুরুত্ব পেতে পারে।'
ডলার-বহির্ভূত বাণিজ্যিক ও আর্থিক ব্যবস্থা গ্রহণের গতি নির্ধারিত হতে পারে ব্রিকসের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের দ্বারা। জোটটির সম্প্রসারণ আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে ডলারের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে বলে মনতব্য করেন গবেষকরা।
গত দেড় বছর ধরে মার্কিন ডলারকে 'অস্ত্র' হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ওয়াশিংটনের সমালোচনা করে আসছে বেইজিং। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পশ্চিমারা, পাশাপাশি রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ ফ্রিজ করে, আন্তর্জাতিক পেমেন্ট ব্যবস্থা সুইফট থেকেও রাশিয়াকে বের করে দেয়। এসব ঘটনার উদাহরণ ওয়াশিংটনের সমালোচনা করে আসছে চীন।
গত কয়েক মাসে ডি-ডলারাইজেশনের পক্ষে কথাবার্তা বাড়ছে। যেমন, গত এপ্রিলে চীন সফরের সময় ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ডা সিলভা প্রকাশ্যে ডলারের পরিবর্তে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেন নিষ্পত্তির আহ্বান জানান।
এই ব্যবস্থায় দুই বা ততোধিক রাষ্ট্র সরকারি পর্যায়ে চুক্তির মাধ্যমে লেনদেনে একটি মুদ্রা ব্যবহার করে।
গত মাসে রাশিয়ার স্টেট ডুমার ডেপুটি চেয়ারম্যান আলেকজান্দার বাবাকভ বলেন, বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য নিষ্পত্তিতে ব্যবহারের জন্য একটি নতুন সাধারণ মুদ্রা চালুর জন্য চুক্তি করতে রাশিয়া কাজ করে যাচ্ছে।
৪ আগস্ট ঝেশাং সিকিউরিটিজ এক প্রতিবেদনে বলে, এই খবরে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে ডি-ডলারাইজেশনের ধারা আরও গতি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এরকম মুদ্রা সফলভাবে চালু হলে মার্কিন ডলারের মতো মুদ্রার আধিপত্য কমতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে দক্ষিণ আফ্রিকার কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বৃহস্পতিবার রয়টার্স এক প্রতিবেদনে বলেছে, ব্রিকসের নিজস্ব মুদ্রা আনার চিন্তা বাদ দেওয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছিল, এই নতুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা অ-ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য ইউরোর মতো কাজ করতে পারবে।
এদিকে বাণিজ্য নিষ্পত্তি, আন্তর্জাতিক পেমেন্ট ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে চীনের মুদ্রার ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। যেমন, অতি সম্প্রতি আর্জেন্টিনা সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেছে ইউয়ানে।
পিপলস ব্যাংক অভ চায়না সম্প্রতি তাদের মুদ্রানীতি প্রতিবেদনে বলেছে, ইউয়ানের আন্তর্জাতিকীকরণ, আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যে মুদ্রাটির ব্যবহার বাড়াতে এবং এর অফশোর মার্কেট গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আগের চেয়ে অনেক বেশিসংখ্যক দেশ এখন তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বৈচিত্র্য আনছে। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে তারা ইউয়ানের মতো উদীয়মান অর্থনীতির মুদ্রাও রিজার্ভ হিসেবে রাখছে।
আইএনজি বলেছে, মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর আন্তর্জাতিক রিজার্ভে ডি-ডলারাইজেশন করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে রিজার্ভে ইউয়ানসহ আরও কয়েকটি মুদ্রার হিস্যা বাড়ছে।
ডাচ ব্যাংকটির তথ্যানুসারে, ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে মার্কিন ডলারের হিস্যা ছিল ৫৮.৬ শতাংশ, যা ১৯৯৫ সালের পর সর্বনিম্ন।
আইএনজির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'দীর্ঘমেয়াদি ঘটনাপ্রবাহ থেকে মনে হচ্ছে মার্কিন ডলার মূলত চীনা ইউয়ান ও [জাপানি ইয়েনের] মতো এশীয় মুদ্রার কাছে জায়গা হারাচ্ছে।'
তবে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের জন্য ইউয়ান এখনও মার্কিন ডলারের মতো আকর্ষণীয় মুদ্রা নয় মোটেই। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের বাইরে আন্তর্জাতিক সম্পদে গত বছর ইউয়ানের হিস্যা সাত বছরে ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে মাত্র ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আর গত বছর আন্তর্জাতিক সম্পদে ডলারের হিস্যা ছিল ৪৯ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক বন্ড মার্কেটেও মার্কিন ডলারই এখনও নেতৃত্ব দিচ্ছে। ব্যাংক খাতের বৈদেশিক দায়ে ডলারের হিস্যা ৪৮ শতাংশ এবং ব্যাংক-বহির্ভূত খাতের জন্য তা ৫১ শতাংশ।