২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা: যে ক্ষত রাজনীতি আজও বয়ে চলেছে
দেশের রাজনীতিতে যে কটি পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে নানা সময়ে, তার মধ্যে ছকের দিক থেকে সবচেয়ে কুৎসিত ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। দেশের প্রধান একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বদানকারীদের ওপর চালানো এ হামলা ছিল দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। সুপরিকল্পিত অথচ চরম নিন্দনীয় এক সহিংসতার চরম রূপ ছিল এ হামলা।
দুর্ভাগ্যবশত, ১৯ বছর পরেও এই জঘন্য হামলার বিচার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি।
হামলায় মারা গেলেন ২৪ জন। অনেকের মৃত্যু হয় ঘটনাস্থলে, যাদের মৃত্যু এতটা সহজ ছিল না। বাংলাদেশ মহিলা লীগের প্রেসিডেন্ট প্রয়াত আইভি রহমানের দুটি পা হাঁটু থেকে উড়ে যায় এ হামলায়। রক্তের বন্যায় স্থবির হয়ে পড়ে ছিলেন দীর্ঘক্ষণ। তিন দিন বাদে, ২৪ আগস্ট করুণ মৃত্যু হয় তার।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তখনকার বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন মুল টার্গেট। অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তার কানের বেশ ক্ষতি হয়েছিল এ ঘটনায়।
সেদিনের ঘটনায় বেঁচে যাওয়া শত শত দলীয় কর্মী এখনও রোজকার জীবন যাপন করেন শরীরে গ্রেনেড হামলার ক্ষত আর স্প্লিন্টারের শত শত টুকরা গেঁথে থাকার বেদনা নিয়ে।
গ্রেনেড হামলার পর মামলা হয়েছিলো পৃথক তিনটি। এর মধ্যে প্রথম সাত বছরের মধ্যেই তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয় মোট ছয়বার। প্রথম তদন্ত হয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে, কিন্তু কোনো প্রতিবেদন দাখিল হয়নি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে নতুন তদন্তে সিআইডির এএসপি ফজলুল কবীর ২০০৮ সালের ১১ই জুন হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দুই মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
মতিঝিল থানায় দায়ের হওয়া হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা দু মামলার রায় ঘটনার দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ই অক্টোবর ঘোষণা করেন ঢাকার বিচারিক আদালত।
এতদিন পরও বিচারিক প্রক্রিয়া এখনো চূড়ান্তভাবে শেষ হয়নি। হাইকোর্টের বিচারকাজ শেষ হলে এরপর আপিল নিষ্পত্তির পর রিভিউ শুনানির বিষয় রয়েছে। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে আরো কত দিন প্রয়োজন সেটি নিশ্চিতভাবে বলতে পারছে না কেউ।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে করা আপিল, জেল আপিল ও ডেথ রেফারেন্স (মৃতুদণ্ডের অনুমোদন) এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
গত বছরের ৫ ডিসেম্বর বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল, জেল আপিল শুনানি শুরু হয়।
বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এ মামলার পেপারবুক পড়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি অসুস্থ থাকায় আপাতত বেঞ্চ বসছেন না। আশা করি সুস্থ হলেই তিনি বেঞ্চে বসবেন। বেঞ্চ বসলেই আমরা শুনানি শেষ করব।"
"শুনানি শুরু হলে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাদের যুক্তিতর্ক তুলে ধরবেন। পরে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরব। শুনানি শেষ করতে আমাদের ১০ থেকে ১২ কার্যদিবস লাগবে। এর বেশি লাগবে না," বলেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রের প্রধান এ আইন কর্মকর্তা বলেন, "আদালতের কাছে আমাদের আবেদন থাকবে বিচারিক আদালতের রায় যেন বহাল থাকে। কারণ আমরা বিচারিক আদালতের পুরো রায় পড়েছি। বিচারক যুক্তি তুলে ধরে, আইনকে বিশ্লেষণ করে সুন্দর রায় দিয়েছেন। এই রায়টা বহাল রাখার জন্য আমরা আবেদন করব। তারেক রহমানসহ সব আসামির রায় বহাল রাখার আর্জি জানাব।"
অক্টোবর মাসের মধ্যে এই মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষ হয়ে রায়ের জন্য প্রস্তুত হবে বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।
ঘটনা ভিন্নখাতে নিতে সাজানো হয় 'জজ মিয়া নাটক'
এই ঘটনা ভিন্নখাতে নিতে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার মামলার তদন্ত ও বিচারে প্রভাব খাটায়।
গ্রেনেড মামলার পরদিন অর্থাৎ ২২ আগস্ট মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন। পরবর্তীতে এই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে পৃথক দুই মামলা হয়।
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তের এক আলোচিত অধ্যায় জজ মিয়া। ২০০৫ সালের ৯ই জুন গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগের একটি চায়ের দোকান থেকে তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় সেনবাগ থানায়।
ঢাকা থেকে সিআইডির অনুরোধ পেয়ে সেনবাগ থানা পুলিশ জজ মিয়াকে গ্রেপ্তারের জন্য সোর্স নিয়োগ করে।
পরে ৯ই জুন বেলা ১টার দিকে জজ মিয়াকে আটক করে থানায় খবর দেয়। এরপর পুলিশ তাকে সেখান থেকে থানায় নিয়ে আসে। ১৭ দিন রিমান্ডে রাখা হয় তাকে, জিজ্ঞাসাবাদ চালায় সিআইডি।
২০০৫ সালের ২৬ জুন আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে জজ মিয়া বলেন, গ্রেনেড হামলায় অংশ নেওয়ার জন্য তাকে টাকা দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে জজ মিয়া জানান, গ্রেনেড হামলায় জড়িত থাকার বিষয়ে বিবৃতি দিতে তাকে ভয় দেখানো হয়েছিল।
পরে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে এই মামলা আবার তদন্তের উদ্যোগ নেয়। তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ জুন মামলা দুটির চার্জশিট দেয় সিআইডি। একই বছর কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জজ মিয়াকে খালাস দেওয়া হয়।