নৌকা, বিমান এবং সাঁজোয়া ট্রেন: কিম জং উন যেভাবে বিদেশ ভ্রমণ করেন
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাত করতে বুলেটপ্রুফ ট্রেনে চড়ে রাশিয়ার বন্দর নগরী ভ্লাদিভস্তকে পৌঁছেছেন উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন। উত্তর কোরিয়ার অন্য নেতাদের মতোই দীর্ঘদিনের রীতি মেনে ২০ ঘণ্টার বেশি সময় এই ট্রেনে ১১৮০ কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করেছেন কিম। সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, দীর্ঘ যাত্রাপথে তাঁর এই ব্যক্তিগত ট্রেনে এমন বন্দোবস্ত রয়েছে যে ট্রেনের ভেতরে রয়েছে একটি রেস্টুরেন্ট, যেখানে সুস্বাদু ফ্রেঞ্চ ওয়াইন এবং তাজা গলদা চিংড়ি দিয়ে তৈরি খাবার পরিবেশন করা হয়।
গুঞ্জন রয়েছে, ট্রেনটিতে কমপক্ষে ২০টি বুলেটপ্রুফ গাড়ি রয়েছে। ফলে সাধারণ ট্রেনের চেয়ে ভারী হওয়ায় ট্রেনটির সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার।
সেই তুলনায় বলা যায়, লন্ডনের হাই-স্পিড রেল চলে ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার গতিতে এবং জাপানের শিনকানসেন বুলেট ট্রেনের গতি ঘণ্টায় ৩২০ কিলোমিটার।
উত্তর কোরিয়ার সেকেলে রেল নেটওয়ার্কের কারণেও অনেক সময় যাত্রা দীর্ঘ হয়ে থাকে।
তবুও কিম জং উনের এই ট্রেনটি সবার চেয়ে আলাদা। ট্রেনটির নাম দেওয়া হয়েছে 'তেইয়াংগো'; কোরিয়ান ভাষায় এর অর্থ সূর্য। এই নামের মাধ্যমে প্রতীকীভাবে উত্তর কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা কিম ইল সাংকেও তুলে ধরা হয়।
দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যের অংশ ট্রেন
ট্রেনে দূরপাল্লার ভ্রমণের রীতি প্রথম শুরু করেন কিম জং উনের দাদা কিম ইল সাং। তিনি নিজের ট্রেনে করে ভিয়েতনাম এবং পশ্চিম ইউরোপে গিয়েছিলেন।
নিরাপত্তা এজেন্টরা এই অভিজাত ট্রেনগুলো কড়া পাহারা দিয়ে থাকে। তারা ট্রেনের যাত্রাপথ স্ক্যান করতে পারে এবং সামনের স্টেশনে বোমা বা কোনো হুমকির আশঙ্কা রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখে।
কিম জং উনের বাবা কিম জং ইল, যিনি ১৯৯৪ সাল থেকে শুরু করে ২০১১ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত উত্তর কোরিয়া শাসন করেছেন, তিনিও ট্রেনে ভ্রমণ করতেন কারণ তার বিমানে উড্ডয়ন ভীতি ছিল।
এর আগে ২০০১ সালে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করতে মস্কোতে পৌঁছাতে ১০ দিন সময় লেগেছিল কিম জং ইলের।
রাশিয়ার সামরিক কমান্ডার কনস্টানটিন পুলিকোভস্কি ২০০১ সালে উত্তর কোরিয়ার সাবেক নেতার সঙ্গে একই ট্রেনে ভ্রমণ করেছিলেন। নিজের স্মৃতিকথা ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে তিনি এই ট্রেনের আভিজাত্যের বিষয়ে লিখেছেন।
"রাশিয়ান, চাইনিজ, কোরিয়ান, জাপানিজ এবং ফ্রেঞ্চ- যেকোনো ধরনের খাবারের অর্ডার দেয়ার সুযোগ ছিল এই ট্রেনে", লিখেছেন তিনি।
তাজা খাবারই যেন খেতে পারেন, সেজন্য ট্রেনেই জীবন্ত গলদা চিংড়ি এনে মজুদ রাখা হতো বলে উল্লেখ করেছেন পুলিকোভস্কি। আবার ফ্রান্সের বোর্দু এবং বার্গান্ডি থেকে নিয়ে আসা হতো রেড ওয়াইন।
এমনকি পুতিনের ব্যক্তিগত ট্রেনেও 'কিম জং ইলের ট্রেনের মতো আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা ছিল না' বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
আরেকজন প্রাক্তন রাশিয়ান কূটনীতিক জর্জি তলোরায়া এই একই সফরে কিম জং ইলের ট্রেনে ভ্রমণের স্মৃতি সম্পর্কে লিখেছেন ২০১৯ সালে। ভ্রমণের সময় তিনি গাধার মাংস এবং পিয়ংইয়ং থেকে নিয়ে আসা 'অ্যাবালন' নামক এক ধরনের শামুক খাওয়ার স্মৃতিচারণ করেছেন। রাশিয়ান স্ট্যান্ডার্ড ভদকাও ছিল খাবারের তালিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এছাড়াও, ভ্রমণের সময় অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য বিভিন্ন গায়ক ও পারফর্মারদের থাকার কথাও দুজনেই উল্লেখ করেছেন।
উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানায়, ২০১১ সালে এই ট্রেনে ভ্রমণের সময়ই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান কিম জং ইল।
২০০৯ সালের নভেম্বরে রক্ষণশীল দক্ষিণ কোরিয়ান সংবাদপত্র চোসুন ইলবোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, এই সাঁজোয়া ট্রেনে প্রায় ৯০টি গাড়ি রয়েছে। সবুজের মাঝে হলদে রেখা টানা ট্রেনটিতে কনফারেন্স রুম, দর্শকদের চেম্বার এবং বেডরুম, স্যাটেলাইট ফোন এবং ফ্ল্যাট-স্ক্রিনের টেলিভিশনও রয়েছে ব্রিফিং এর জন্য।
অন্যান্য ছবিতে দেখা গেছে, গাড়িগুলোতে লাল লেদারের আর্মচেয়ার রয়েছে।
তবে কিম জং উনের তার বাবার মতো বিমান-ভীতি নাও থাকতে পারে; যেহেতু এরই মধ্যে রাশিয়ায় তৈরি ব্যক্তিগত জেট বিমানে করে তিনি কয়েকবার ভ্রমণ করেছেন।
কিন্তু ২০১৯ সালে যখন কিম রাশিয়ার দূরপ্রাচ্যের শহর ভ্লাদিভস্তকে গিয়েছিলেন পুতিনের সঙ্গে দেখা করতে, তখনও তিনি ট্রেনে করেই গিয়েছিলেন। রাশিয়ার প্রথাগত রীতি অনুযায়ী, রুটি ও লবণ খাইয়ে তাকে স্বাগত জানিয়েছিল কর্মকর্তারা।
ব্যক্তিগত বিমান
ট্রেনে ভ্রমণের বাইরেও, কিম জং উনকে আরও অনেক ধরনের বিলাসবহুল বাহনে করে ভ্রমণ করতে দেখা গিয়েছে; যা উত্তর কোরিয়ার জনসাধারণে দরিদ্র জীবনধারার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে।
সুইজারল্যান্ডের বোর্ডিং স্কুলে পড়ার সুবাদে কিম জং উন অবশ্যই আকাশপথে ভ্রমণের সঙ্গে অপরিচিত নন। ক্ষমতায় আসার পর ২০১৮ সালে তিনি বিমানে চড়ে প্রথম আন্তর্জাতিক সফরে যান চীনের দালিয়ান শহরে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর সঙ্গে দেখা করতে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, কিম এর আগেও উত্তর কোরিয়ার অভ্যন্তরে ভ্রমণের জন্য তার ব্যক্তিগত জেট বিমান ব্যবহার করেছেন।
যেই জেট বিমানটি তাকে চীনে উড়িয়ে নিয়ে যায় সেটি ছিল সোভিয়েতের তৈরি একটি লং-রেঞ্জ বিমান 'ইলুশিন-৬২'।
এনকে নিউজ ওয়েবসাইটে উত্তর কোরিয়ার পর্যবেক্ষকরা বলেন, স্থানীয়রা এই জেট বিমানটিকে 'চামে-১' বলে ডাকেন। উত্তর কোরিয়ার জাতীয় পাখির নামে এই নাম দেওয়া হয়েছে।
সাদা রঙ এর বিমানের বহির্সজ্জায় দুই পাশেই কোরিয়ান ভাষায় উত্তর কোরিয়ার অফিসিয়াল নাম লেখা। সেই লেখার পাশেই রয়েছে দেশটির জাতীয় পতাকা। বিমানের টেইলের অংশে লাল ও নীল বৃত্তের ভেতরে একটি লাল তারা রয়েছে।
বিমানটিতে রয়েছে আধুনিক ইন্টেরিয়র বা অন্দরসজ্জা; এবং এই বিমানের ভেতরে কিমের কাজ করা বা বৈঠকের আয়োজন করার ছবিও দেখা গেছে।
২০১৮ সালে কিমের বোন কিম ইয়ো জং-সহ পিয়ংইয়ংয়ের উচ্চ পর্যায়ের অলিম্পিক প্রতিনিধিদলকে দক্ষিণ কোরিয়ায় নিয়ে যাওয়ার সময় খবরের শিরোনাম হয় চামে-১।
দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদ সংস্থা ইয়োনহ্যাপ জানিয়েছে, ফ্লাইটটিতে শনাক্তকরণ নম্বর হিসেবে 'পিআরকে'৬১৫' ব্যবহৃত হয়েছে; সম্ভবত ২০০০ সালের ১৫ জুন দুই দেশের 'নর্থ-সাউথ জয়েন্ট ডিক্লারেশন'-এ স্বাক্ষরকে এর মাধ্যমে প্রতীকীভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
এছাড়াও, ২০১৪ সালে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত চ্যানেল কোরিয়ান সেন্ট্রাল টেলিভিশনে প্রচারিত একটি তথ্যচিত্রে কিমকে একটি ইউক্রেনীয় 'আন্তোনভ-১৪৮ (এএন-১৪৮)' ব্যবহার করতে দেখা গেছে, যাতে উত্তর কোরিয়ার সরকারি এয়ারলাইন 'এয়ার কোরিয়ো'র লোগো ছিল।
২০১৫ সালে উত্তর কোরিয়ার সরকারি গণমাধ্যম কিমের নিজের দেশে তৈরি একটি বিমান চালানোর ফুটেজও প্রকাশ করে।
বিলাসবহুল গাড়ি
২০১৮ সালের মার্চে কিম জং উন ট্রেনে করে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে ভ্রমণ করেন, কিন্তু শহরের মধ্যে যাতায়াতের জন্য ব্যক্তিগত মার্সিডিজ-বেঞ্জ-এস-ক্লাস গাড়িটিকে তিনি নিজের সঙ্গেই রাখেন।
দক্ষিণ কোরিয়ান সংবাদপত্র জুংআং ইলবোর তথ্যানুযায়ী, গাড়িটি বিশেষভাবে ট্রেনে করে নিয়ে আসা হয়েছিল।
২০১০ সালে তৈরি এই গাড়ির দাম প্রায় ১.৮ মিলিয়ন ডলার বলে জানায় গণমাধ্যমটি।
২০১৮ সালে পানমুনজমে আন্তঃকোরিয়ান সম্মেলনে কিমের প্রিয় এস-ক্লাস মডেলের গাড়িটি বিশেষভাবে নজরে আসে। এ সম্মেলনে তার গাড়িবহরে একটি ব্যক্তিগত টয়লেট কারও ছিল, যা ভ্রমণের সময় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেছেন এই নেতা।
সিউল-ভিত্তিক ওয়েবসাইট ডেইলি এনকের ২০১৫ সালের একটি প্রতিবেদনেও এটির কথা উল্লেখ করা হয় যে, কিমের গাড়িবহরের সঙ্গে থাকার জন্য কাস্টমাইজড টয়লেট কার বানানো হয়েছে।
রহস্যময় ইয়ট
উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে কিম জং উনকে নৌকা, সাবমেরিন, বাস, এমনকি স্কি লিফটে চড়তেও দেখা গেছে।
এছাড়া, আরও অনেক ধরনের বাহনেই তিনি চড়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে; তবে সেগুলো এখনও প্রকাশ্যে আসেনি।
২০১৩ সালের মে মাসে কিমের সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি ফিশিং স্টেশন পরিদর্শনের ছবি প্রকাশ করেছিল দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম। সেই ছবিতে পেছনে একটি ইয়ট ছিল বলে জানায় এনকে নিউজ।
ইয়টটির আনুমানিক মূল্য হতে পারে ৭ মিলিয়ন ডলার। যদিও এটি কিমেরই কিনা, কিংবা বিলাসপণ্যের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এটি কিভাবে আমদানি করা হলো- সেসব বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে দামের দিক বিবেচনায় অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কিম জং উনকেই এটির মালিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৫ সালের জুনে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক রেডিও এশিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়- দক্ষিণ পিয়ংগান প্রদেশে কিমের বিলাসবহুল বাড়ির ছাদে একটি নতুন হেলিপ্যাড দেখেছেন জনৈক গবেষক।
জন হপকিন্স স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর ইউএস-কোরিয়া ইনস্টিটিউটে কর্মরত ওই গবেষক বলেছিলেন, হেলিপ্যাডটি সম্ভবত কিমের পরিবার বা সেখানে আগত অতিথিরা ব্যবহার করেন।