সম্ভাবনা থাকলেও সহায়তার অভাবে আশার আলো দেখছে না চারা গাছ রপ্তানি
বাংলাদেশে অনুকূল পরিবেশে স্বল্প খরচে চারা গাছ উৎপাদন সম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যসহ আরব আমিরাতের দেশগুলোতে রপ্তানিতে বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তা কাজে লাগাতে পারছে না রপ্তানিকারকরা।
বছর দুয়েক আগে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দিয়ে প্রথম বারের মতো বাংলাদেশি ফলজ গাছের চারা রপ্তানি শুরু হয়েছিল। এর আগে কয়েক বছর অবশ্য বিমান কার্গোতে করেও স্বল্প পরিমাণে জীবন্ত গাছের চারা গিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে। সেসময় নতুন রপ্তানি পণ্য হিসেবে আশা জাগিয়েছিল চারা গাছ।
কিন্তু এরপর থেকে কোনো উল্লেখযোগ্য প্রচারমূলক প্রচেষ্টা নেওয়া হয়নি।
গত বছরের ২২ জুলাই দুবাইতে নিযুক্ত কমার্শিয়াল কাউন্সেলর কামরুল হাসানের পাঠানো এক চিঠিতে বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়।
চিঠিতে রপ্তানি উৎসাহিতকরণে প্রণোদনা প্রদান, রেফার কনটেইনার প্রাপ্যতা সহজলভ্যতা নিশ্চিতকরণ, কোকোপিট আমদানিতে শুল্কমুক্ত বা হ্ৰাস করা, অনাপত্তি সনদ প্রদানে দ্রুততা, ইপিবির মধ্যপ্রাচ্যে চারা গাছের প্রচারণামূলক মেলার আয়োজন করা, বিমানের ফ্রেইট চার্জ কমানো এবং গ্রিন হাউস, ওয়াশিং ইউনিট ও প্যাকেজিং শেড নির্মাণের জন্য প্রণোদনা প্রদানের বিষয়ে করা সুপারিশ করা হয়।
এসব পদক্ষেপ নেওয়া হলে বাংলাদেশে অনুকূল পরিবেশে কম খরচে চারা উৎপাদন করা সম্ভব বলে উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।
বাংলাদেশের চারা রপ্তানি যাত্রা
মূলত মাটি ছাড়া চারা গাছ রপ্তানির হয় বিদেশে। কারণ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে শেকড়ে মাটি থাকা যাবে না। গ্রিন হাউজের মাধ্যমে ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে চারাগুলোকে। এরপর তা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেফার কনটেইনারে করে বিদেশে পাঠানো হয়।
২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে বিমানের মাধ্যমে প্রথমবার পাঁচ হাজার ফলজ গাছের চারা কাতারে রপ্তানি করেন কুমিল্লার মোহাম্মদ শামসুল আলম। এরমধ্যে ছিল আম, জাম, লেবু, সফেদা, ডুমুর, নিম, লিচুর চারা।
২০২১ সালে প্রথম বারের মতো চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দিয়ে রপ্তানি করেন শামসুল। বর্তমানে দুবাইয়েও রপ্তানি করেছেন তিনি। দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রায় এক লাখেরও বেশি চারা রপ্তানি করেছেন তিনি।
রপ্তানিকারক এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইংয়ের তথ্যমতে, গত চার বছরে চারা গাছ রপ্তানি খাতের অগ্রগতি বলতে আরো চার প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে এ খাতে।
গাইবান্ধার সাত ভাই নার্সারী ২০২১ ও ২০২২ সালে দুই চালানে তুরস্কে প্রায় ৬ হাজার চারা গাছ রপ্তানি করেছে। ফলের চারার মধ্যে আম, কাঁঠাল, লিচু ও ফুলের মধ্যে রঙ্গন, কামিনী রয়েছে। আগামী একমাসের মধ্যে আরো ৩ হাজার চারা রপ্তানি করবে তারা।
কুমিল্লার মেসার্স খাদিম এন্টারপ্রাইজ ২০২২ সালে দুবাইয়ে ৫৩৩০টি এবং মালদ্বীপে নমুনাস্বরূপ ১০০ ফলজ গাছের চারা রপ্তানি করেছে।
বর্তমানে সিরিয়া, মিশর, নেদারল্যান্ডস, ভারত, পাকিস্তান, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং তুরস্ক উচ্চমানের চারা রপ্তানিকারক দেশ।
প্রয়োজন সহায়তা-সমর্থন
সাত ভাই নার্সারির মালিক সাইফুল ইসলাম কল্লোল জানান, চারা রপ্তানির জন্য একটি অনাপত্তি শংসাপত্র (এনওসি) প্রয়োজন হয়। কিন্তু এটি যোগাড় করতে বিলম্ব হয় রপ্তানিতে।
"তাছাড়া আমাদের লোডিং পয়েন্টে রেফার কন্টেইনার সুবিধা না থাকায় চারাগুলোর গুণমান প্রভাবিত হয়, রপ্তানিতে বিলম্ব হয়," বলেন তিনি।
বাংলাদেশ থেকে প্রথম চারা রপ্তানিকারক শামসুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) স্থানীয় পণ্য রপ্তানি বাড়াতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার আয়োজন করে। কিন্তু এখানেও নেই রপ্তানি চারার উপস্থিতি।
"এই ধরনের ইভেন্টে অন্তর্ভুক্ত হতে পারলে অন্যান্য দেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের আরো ক্রেতা আকৃষ্ট করতে পারবো আমরা। আমাদের সম্ভাব্য সাফল্য নিয়ে আত্মবিশ্বাসী আমি," বলেন এই রপ্তানিকারক।
মধ্যপ্রাচ্যের জলবায়ুতে টিকে থাকতে পারে এমন চারার জাত সনাক্তকরণে সরকারি উদ্যোগে গবেষণার গুরুত্বের উপর জোর দেন খাদিম এন্টারপ্রাইজের মালিক বশির মিয়া খাদিম।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (গবেষণা) মো. আবদুল্লাহ ইউসুফ আকন্দ চারা রপ্তানি নিয়ে গবেষণার অনুপস্থিতির কথা স্বীকার করেন। তিনি আরো জানান, এই সম্ভাবনাময় খাত সম্পর্কে তারা তেমন একটা অবগত নন।
সম্ভাব্য বাজার মধ্যপ্রাচ্য
মার্কিন-ভিত্তিক স্ফেরিক্যাল ইনসাইটস অ্যান্ড কনসাল্টিং এর প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বব্যাপী উদ্ভিদজাত ফ্যাক্টরির বাজারের আকার ২০২২ সালে ছিল ১২১.৯ বিলিয়ন ডলার; যা ২০৩২ সালের মধ্যে ২৪২.২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।
কপ২৭-এ মিডেল ইস্ট গ্রিন ইনিশিয়েটিভ সামিটে সৌদি আরব বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ ২.৫% কমাতে মধ্যপ্রাচ্যে ৫০ বিলিয়ন গাছ লাগানোর পরিকল্পনার কথা জানায়। এরমধ্যে ১০ বিলিয়ন গাছ লাগানো হবে সৌদি আরবেই।
এ লক্ষ্যের অংশ হিসেবে ২০২২ সালে সৌদির রাজধানী রিয়াদে প্রায় ৬০ হাজার গাছ লাগানো হয়; এবং পুরো দেশে ৮.৪ মিলিয়ন গাছ লাগানো হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আম, জাম, লেবু, স্যাপোডিলা, ডুমুর, নিম, লিচু এবং ফুলের গাছসহ নানাবিধ ফল গাছের চাহিদা রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন রপ্তানিকারকরা। এসব গাছের চারা বাংলাদেশ থেকে সহজেই রপ্তানি করা যাবে বিধায় সম্ভাবনাময় এ বাজারে প্রবেশের জন্য সংশ্লিষ্টদের সহায়তা চেয়েছেন তারা।