নারীরা কেন জনসমক্ষে পুরুষদের তুলনায় কম প্রশ্ন করেন?
বিগত বছরগুলোতে আমি কয়েক ডজন রেডিও শো উপস্থাপনা করেছি এবং সশরীরে উপস্থিত দর্শকদের সামনে শত শত পাবলিক ইভেন্টে সভাপতিত্ব করেছি। প্রতিটি সেশন শেষে 'প্রশ্নোত্তর পর্ব' খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় বলেই আমি মনে করি, তাই আমি চাই দর্শকদের মনে কোনো প্রশ্ন থাকলে তারা তা জিজ্ঞাসা করুক। কিন্তু আমি দর্শকদের যতই সাহস ও স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করি না কেন, সবসময়ই নারীদের তুলনায় পুরুষ প্রশ্নকর্তার সংখ্যাই বেশি থাকে এবং প্রায়ই দেখা যায়, একজন নারীও প্রশ্ন করতে প্রথমে হাত তোলেননি।
এমন হতেই পারে, নারীদের আসলে প্রশ্ন করার মতো তেমন কিছু নেই। কিন্তু অসংখ্যবার এমন হয়েছে, অনুষ্ঠান শেষে ওই নারীদের অনেকেই আমাকে বলেছেন, তারা প্রশ্ন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু করেননি। আর প্রতিবারই দেখেছি, ওটা ছিল দুর্দান্ত একটি প্রশ্ন।
একক কোনো উদাহরণ দিয়ে যদিও সবাইকে বিচার করা যায় না, কিন্তু বছরের পর বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমি এ বিষয়ক পরিসংখ্যানের দিকে তাকাতে বাধ্য হই। যদিও বিষয়টি নিয়ে বেশিরভাগ গবেষণাই জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ইভেন্টের বদলে একাডেমিক কনফারেন্সে থাকা দর্শকদের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে করা হয়েছে, তবুও এটি শিক্ষণীয়। গবেষণায় এটিও প্রমাণিত, আমার অভিজ্ঞতা খুব আলাদা কিছু নয়, বরং এটিই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সুশানা জারভিসের গবেষণার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০২২ সালে প্রকাশিত ওই গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, তিনি একটি সম্মেলনে প্রশ্নকর্তাদের পর্যবেক্ষণ করেছেন। উল্লেখ্য যে, প্রশ্নকর্তাদের মধ্যে জীববিজ্ঞানী থেকে শুরু করে জ্যোতির্পদার্থবিদ এবং অর্থনীতিবিদও ছিলেন। এটি ছিল এমন একটি সম্মেলন যেখানে প্রশ্ন করতে চাইলে আপনাকে নিজের আসন ছেড়ে উঠে গিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে একটি সারিতে গিয়ে দাঁড়াতে হবে, যেন বাকিরা সবাই আপনাকে দেখতে পান। এ সম্মেলনে প্রতিনিধিদের মধ্যে ৬৩% ছিলেন পুরুষ, তাই আপনার ধারণা হতে পারে যে ৬৩% প্রশ্ন আসবে পুরুষদের কাছ থেকে। কিন্তু দেখা গেছে, ৭৮% প্রশ্নই এসেছে পুরুষদের কাছ থেকে।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অ্যালেসিয়া কার্টারের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি গবেষণায়ও একই চিত্র দেখা গেছে। ১০টি দেশের ২৫০ একাডেমিক বিভাগীয় সেমিনার পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তিনি। সেখানে দেখা যায়, নারী-পুরুষ অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা গড়ে সমান হলেও, পুরুষদের তুলনায় নারীদের প্রশ্ন করার প্রবণতা আড়াই গুণ কম।
এটা অবশ্য সত্যি যে, যারা যারা প্রশ্ন করেছেন গবেষকরা শুধু সেই হিসাবই তুলে ধরেছেন এসব গবেষণায়। এর বাইরে অনেকেই থাকতে পারেন যারা হাত তুলেছিলেন, কিন্তু প্রশ্ন করার সুযোগ পাননি। এমনও হতে পারে, মডারেটররা পুরুষদের প্রশ্নই বেশি নিয়েছেন। কিন্তু বারবার পুরুষদেরই বেশি প্রশ্ন করার এই অভিজ্ঞতার কারণে শিক্ষা-গবেষণা নিয়ে কর্মরত গোষ্ঠীর কেউ কেউ এটাকে 'কোয়েশ্চেন অ্যান্ড ম্যানসার' সেশন বলে অভিহিত করেছেন।
কিন্ত কিছু নারী কেন পিছিয়ে থাকেন?
প্রশ্ন করার মতো কিছু নেই বলে তারা প্রশ্ন করেন না, বিষয়টি এমন নয়। অ্যালেসিয়া কার্টার বিশ্বের ২০টি দেশের ৬০০ একাডেমিকের উপর জরিপ চালিয়েছেন এবং তাদের উত্তরগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। মজার বিষয় হলো, এতে দেখা গেছে নারী-পুরুষ উভয়েই বলেছেন, তাদের মনে প্রশ্ন থাকলেও তারা প্রশ্ন করেননি। কিন্তু বেশিরভাগ নারীরই উত্তর ছিল- তাদের সাহসে কুলোয়নি প্রশ্ন করার। তারা এই ভেবে চিন্তিত ছিলেন, তারাই হয়তো কথাপ্রসঙ্গ বুঝতে পারেননি, বক্তাকে হয়তো ভীতিকর মনে হয়েছে তাদের কাছে কিংবা তাদের মনে হয়েছে একটি ভালো প্রশ্ন করার মতো বুদ্ধিমান তারা নন। কারণ কেউই চায় না ৩০০ লোকের সামনে ভুল প্রশ্ন করে লজ্জিত হতে যে, তারা নিজেরাই মূল পয়েন্টটি মিস করে গেছেন। কিন্তু একইসঙ্গে গবেষণায় এও বলা হয়েছে, এ ধরনের প্রবৃত্তি নারীদের আরও নিরস্ত করে রাখে।
যুক্তরাষ্ট্রে জারভিস দেখেছেন, নারীরা বলেছেন প্রশ্ন করার বেলায় তাদের মধ্যে উদ্বেগ কাজ করে। অন্যদিকে, পুরুষেরা বলেছেন অন্যদের কথা বলার সুযোগ দিতে তারা নিজেরা প্রশ্ন করেননি এবং প্রশ্নোত্তর পর্বে নিজেরাই কেবল প্রভাব বিস্তার না করতে সক্রিয় পদক্ষেপও নিয়েছেন কেউ কেউ।
নারীদের তুলনায় দ্বিগুণ সংখ্যক পুরুষ বলেছেন, তারা প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন; কারণ তাদের মনে হয়েছে, বক্তার কথার মধ্যে ভুল বা অসঙ্গতি রয়েছে। শুনতে খারাপ লাগলেও, যেহেতু এগুলো একাডেমিক ইভেন্ট, তাই দর্শকদের সমালোচনার জবাব দেওয়াও পুরো প্রক্রিয়ারই একটা অংশ।
এছাড়াও, গবেষকরা নারী এবং পুরুষদের প্রশ্নের ধরনের দিকেও নজর দিয়েছেন। কখনো কখনো দাবি করা হয়, পুরুষেরা নারীদের তুলনায় বেশি লম্বা প্রশ্ন করেন বা একবারে একের অধিক প্রশ্ন করতে চান।
কিন্তু এখানে শুধুমাত্র পুরুষেরাই দায়ী নন। ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স-এর গিলিয়ান স্যান্ডস্টর্ম ১৬০টি লাইভ সম্মেলন বা পাবলিক ফেস্টিভ্যালে দর্শকদের জিজ্ঞাসা করা ৯০০র বেশি প্রশ্ন বিশ্লেষণ করেছেন। তার গবেষণাটি প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। এ গবেষণায় তিনি জেন্ডারভিত্তিক কোনো পার্থক্য দেখতে পাননি। নারীদেরকেও তিনি পুরুষদের মতোই দীর্ঘ প্রশ্ন করতে দেখেছেন বা প্রশ্নের একাধিক অংশ ছিল।
প্রশ্নের অন্যান্য বৈশিষ্ট তুলনা করতে গেলে, যেমন- বক্তার উদ্দেশে হ্যালো বলে আরম্ভ করা বা নিজেদের পরিচিয় দেওয়া; এখানে নারী-পুরুষের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য ছিল এই যে- নারীদের মধ্যে বক্তাকে অভিবাদন জানানোর প্রবণতা বেশি দেখা গেছে।
তাই একমাত্র প্রধান পার্থক্য হচ্ছে, কে আগে প্রশ্নটা করবেন?
আপনি বলতে পারেন, যেহেতু সময় কম থাকে তাই সবাই প্রশ্ন না করলেও কিছু যায়-আসে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, অর্ধেক দর্শকই যদি প্রশ্ন করতে অনাগ্রহী হন, তাহলে ওই প্রশ্নোত্তর পর্ব ততটা বৈচিত্র্যময় ও কৌতূহলোদ্দীপক হয় না। এখন পর্যন্ত শুধু নারী ও পুরুষের ওপর এ ধরনের গবেষণা করা হয়েছে, সমাজের আরও অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীর ওপর গবেষণা করা প্রয়োজন যে, তারাও প্রশ্ন করার বেলায় এমন থেমে যান কিনা।
কর্মক্ষেত্রে প্রশ্ন করার মাধ্যমে আপনি অন্যদের নজরে আসতে পারেন এবং যদি সেরা কাজটা পেতে চান, তাহলে নজরে আসা গুরুত্বপূর্ণ বটে! ফ্রান্সের একটি সম্মেলনে পরিচালিত গবেষণায় গবেষক জুনহানলু ঝ্যাং দেখেছেন, সিরিয়াল প্রশ্নকর্তাদের নাম অন্যরা বেশি মনে রাখে। তবে সেটা যে ইতিবাচকভাবেই মনে রাখে সবাই, তা কিন্তু নয়। হয়তো বারবার প্রশ্ন করার জন্য অনেকেই বিরক্তির সঙ্গে মনে রেখেছেন তাকে!
সার্বিকভাবে নারীদের কম প্রশ্ন করার আরেকটি সমস্যা হলো, একাডেমিক ক্যারিয়ারের শুরুতে নারীদের সামনে নারী রোল মডেলের অভাব- যারা কিনা তাদের অনুপ্রাণিত করবে যে প্রশ্ন করার বেলায় ভয়ের কিছু নেই।
মহামারিকালে যখন অনলাইনে বিভিন্ন ইভেন্ট হতো, তখন সবার সামনে কথা না বলেও প্রশ্ন করার উপায় ছিল। প্রশ্ন টাইপ করে দেওয়া যেত চ্যাট বক্সে, কখনো কখনো পরিচয় গোপন রেখেও দেওয়া যেতো। সেখানে হাত তোলার কোনো ঝামেলা ছিল না, আমার প্রশ্ন নেওয়া হবে কি হবে না, মাইক্রোফোন কাজ করবে নাকি করবে না- সেইসব ভয় ছিল না। এমনকি বর্তমানে সশরীরে অনুষ্ঠিত অনেক ইভেন্টেও অ্যাপ ব্যবহার করা হচ্ছে, যেখানে আপনি নিজের ফোন ব্যবহার করেই প্রশ্ন করতে পারবেন যা পৌঁছে যাবে অনুষ্ঠানের সভাপতির কাছে।
আবার যদি প্রশ্ন করার আগেই সেই উত্তরটি বক্তার কথায় উঠে আসে (যখন কিনা আপনার মনোযোগ ছিল অন্যদিকে), তাহলে সভাপতি আর প্রশ্নটি প্যানেলের কাছে তুলবেন না। তারা এটা এড়িয়ে যাবেন। তাহলে এখানেও উদ্বেগ কমে যেতে পারে। কিন্তু অনলাইন ইভেন্টে কি নারীরা পুরুষদের সমানই প্রশ্ন করেন? ঝ্যাং এর গবেষণা বলছে- না।
২০২১ সালের জুনে বায়োইনফরমেটিকস বিষয়ে অনলাইনে অনুষ্ঠিত একটি ফরাসি সম্মেলনে নারী-পুরুষেরা কতগুলো প্রশ্ন করেছে তা রেকর্ড করেছিলেন ঝ্যাং। সাধারণত এ ধরনের সম্মেলনে পুরুষ প্রতিনিধিই বেশি থাকে, কিন্তু অনলাইনে সম্মেলনে দেখা গেল নারী ও পুরুষ প্রতিনিধির সংখ্যা প্রায় সমান। তবুও সেখানে পুরুষেরা ১১১টি প্রশ্ন করেছেন, নারীরা করেছেন ৫৭টি। জ্যেষ্ঠতার দিক থেকেও পার্থক্য ছিল, ৩৫ বছরের বেশি বয়সী পুরুষেরা তাদের চেয়ে বয়সে ছোট নারী ও জেন্ডার সংখ্যালঘুদের চেয়ে ৯ গুণ বেশি প্রশ্ন করেছেন।
স্যান্ডস্টর্ম মনে করেন, মডারেটরদেরও এখানে ভূমিকা আছে যেন সবাই প্রশ্ন করার সাহস পায়। ঝ্যাং এর গবেষণায় দেখা গেছে, সভাপতির জেন্ডার কোনো প্রভাব ফেলেনি এখানে। কিন্তু তারা হয়তো ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে পারেন পার্থক্য গড়ে তোলার জন্য।
দেখা গেছে, পুরুষেরা যদি প্রথমেই প্রশ্ন করেন, তাহলে পরে নারীরা প্রশ্ন করতে কম এগিয়ে আসেন। বিষয়টা এমন মনে হয় যে, সেশনের বাকি সময়টাও এভাবেই চলবে। তাই কৌশলটা হতে পারে, প্রথমে প্রশ্ন করার জন্য একজন নারী প্রশ্নকর্তাকেই বেছে নেওয়া এবং তিনি যেন খুব বয়োজ্যেষ্ঠ না হন। অবশ্য যদি অন্য জুনিয়র নারী প্রশ্নের জন্য হাত তোলেন, তবেই এই কৌশল কাজ করবে। আর কোনো নারীই যদি প্রশ্ন করতে আগ্রহী না হন, তাহলে আমি কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই গবেষণার কথা বলি তাদেরকে, এরপরে জিজ্ঞাসা করি, কোনো নারী আগে প্রশ্ন করতে চান কিনা।
একই গবেষণায় আরও একটি বিকল্প পন্থার কথা বলা হয়েছে- মূল বক্তা বা প্যানেল এবং প্রশ্নোত্তর পর্বের মধ্যে সংক্ষিপ্ত বিরতি নেওয়া। এটি একটি ধূর্ত প্রক্রিয়া কারণ এই বিরতির মাঝে দর্শকরা তাদের আশেপাশের মানুষকে তাদের প্রশ্নগুলো জানাবে, উত্তর পাওয়ার চেষ্টা করবে। আমি এ পদ্ধতি অনুসরণ করে ভালো ফল পেয়েছি এবং এতে করে বেশি প্রশ্ন উঠে এসেছে। কারণ এর মাধ্যমে মানুষ আগেই পরীক্ষা করে নিতে পারে যে, তার প্রশ্নটি মূর্খের মতো প্রশ্ন হবে কিনা কিংবা আগেই এর জবাব দেওয়া হয়ে যায়নি (যখন সে নিজে অমনোযোগী ছিল)।
দীর্ঘতর সেশনের মধ্যে নারীদের কাছ থেকে প্রশ্ন বেশি পাওয়া যায় বলেও গবেষণায় উঠে এসেছে। তাই দর্শককে বেশি সময় দেওয়ার ব্যাপারেও যুক্তি দিতে পারেন কেউ কেউ। যদিও আমার মনে হয়, সবাই এতে একমত হবেন না।
তবে আপাতত আমাদেরকে বিভিন্ন শিক্ষাগত পরিবেশে পরিচালিত গবেষণার ওপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে। কিন্তু পাবলিক মিটিংয়েও একই ঘটনা ঘটে কিনা তা জানতে পারলে দারুণ হবে। উপরে উল্লিখিত কৌশলগুলোর সুবিধা হলো এই যে, এগুলো শুধুমাত্র নারীদেরই সাহায্য করবে না, বরং যাদেরই মনে হবে তারা সঠিক মূল্যায়ন পাচ্ছেন না, তাদেরকে মুখ খুলতে উদ্বুদ্ধ করবে।