ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য ইউক্রেনের পালটা আক্রমণের সাফল্য গুরুত্বপূর্ণ?
রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের চলমান পালটা আক্রমণ সম্ভবত বার্লিন দেওয়াল পতন বা এমনকি ১৯৪৫ সালের পর থেকে ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। আক্রমণের এ পর্যায়ে এসে যতটা অগ্রগতি ইউক্রেন বাহিনী আশা করেছিল, তার সিকিভাগও অর্জন করতে পারেনি তারা।
যুদ্ধ পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, কোনো একটি ছোট শহর বা গ্রাম ইউক্রেনীয়রা পুনর্দখল করতে পারলেও তার বিধ্বস্ত পরিণতি এড়ানোর কোনো উপায় থাকে না। এসব স্থানে ইউক্রেনীয় সেনাদের আশ্রয় নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত ভবনও অক্ষত পাওয়া যায় না।
ইউক্রেনের এ লড়াই তার নিজের ভূমি স্বাধীন করার জন্য। কিন্তু এটি একইসঙ্গে ইউরোপের নিরাপত্তার একটি জ্বলজ্বলে মুহূর্তও। আগামী দুমাসে এ লড়াইয়ের ফলাফল বৈশ্বিকভাবে আগামী এক দশকের পরিস্থিতি হয়তো ঠিক করে দেবে।
গত মাসে দক্ষিণ ফ্রন্টে ইউক্রেন আক্রমণে গতি পেয়েছিল। কিন্তু এখন আবার তা থমকে গেছে। কিয়েভের বাহিনী খুবই ধীরগতিতে মারিওপোলের দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু তার জন্য তাদেরকে ভীষণ মূল্যও চোকাতে হচ্ছে।
তবে লড়াই থেমে নেই। আর এ লড়াই সেই শুরুর মতোই এখনো সমান গুরুত্বপূর্ণ। নভেম্বরের শেষের দিকে আবহাওয়া ক্রমশ ঠান্ডা হতে থাকবে। তারপর দ্রুতই শীত নেমে আসবে।
শীতের বরফ আর রাস্তার কাদা দুটোই ইউক্রেনের সাঁজোয়া যানের জন্য অনুপযুক্ত। তবে কিয়েভের সর্বশেষ বড় অগ্রগতি দেখা গেছে গত বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। তাই একদিক থেকে বলা যায়, ইউক্রেনের কাছে আরও আট সপ্তাহ বাকি আছে।
বরফ পড়তে শুরু করলে মস্কো তার ফ্রন্টলাইন আরও শক্তিশালী করবে। তখন দিনের আলোও কমে আসবে। ঠান্ডার দরুন ইউক্রেনীয় বাহিনীকে রাশিয়ার ফ্রন্টলাইনে আক্রমণ চালাতে আরও বেশি শক্তি খরচ করতে হবে, ঝুঁকিও বাড়বে।
ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট তার অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য শীতের অপেক্ষা করছেন। অনেকের অনুমানকে মিথ্যা করে দিয়ে তার বাহিনী এ গ্রীষ্মে দারুণ শক্তিমত্তা দেখিয়ে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে।
তবে পুতিন-বাহিনীর সামনে পশ্চাদপসরণের এখনো সম্ভাবনা আছে। কারণ তাদের মানবসম্পদ অক্ষয় নয়। আর রাশিয়ার সরবরাহ লাইনের ওপর ইউক্রেনের ধীরলয়ের আক্রমণও একসময় রুশ বাহিনীকে নাকানিচুবানি খাওয়াতে পারে। আবার সবকিছু সামলে রাশিয়া টিকে যাবে — এমনটাও অসম্ভব নয়।
পশ্চিমারা কিয়েভকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার এখনো একই উদ্যমে জানিয়ে যাচ্ছে। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় ওয়াশিংটনের সপ্তাহে সপ্তাহে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সহায়তা সামনে হোঁচট খেতে পারে।
বলা বাহুল্য, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অনির্দিষ্ট ফলাফলের এ যুদ্ধে মার্কিন করদাতাদের অর্থ ঢালার চেয়ে কোনো সমাধান খুঁজে বের করে তা নিয়ে আগামী নির্বাচনের প্রচারণা চালাতে বেশি পছন্দ করবেন।
অনেক রিপাবলিকান ইতোমধ্যে এ যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন। রিপাবলিকান পার্টির প্রেনিডেন্সিয়াল মনোনয়নের সামনে থাকা ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বাস করেন, তিনি অলৌকিকভাবে এ যুদ্ধ ২৪ ঘণ্টায় শেষ করে দিতে পারেন। ওদিকে পুতিনের সমালোচনা করতেও ইচ্ছুক নন ট্রাম্প।
ইউরোপের সমর্থনও এখন আর আগের মতো শক্তপোক্ত নয়। অর্থনৈতিক চাপের মুখে যুদ্ধ প্রসঙ্গে ইউরোপ তার ঐক্য হারাচ্ছে। মার্কিন সমর্থন কমে গেলে ইউরোপও এ যুদ্ধ থেকে নিজেকে আরও দূরে সরিয়ে নিতে পারে। এছাড়া আসন্ন শীতে জ্বালানির উচ্চমূল্যের নতুন ধাক্কা তো রয়েছেই।
দক্ষিণাঞ্চলে ফ্রন্টলাইনে শীত জেঁকে বসলে যুদ্ধ নতুন করে তীব্র মোড় নেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। মস্কোতে ড্রোন হামলা চালানো, আন্তঃসীমান্ত আক্রমণ, এবং দীর্ঘপাল্লার মিসাইল দিয়ে ক্রিমিয়ায় হামলার ক্ষেত্রে ইউক্রেন ক্রমেই অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। আক্রমণকারী প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে কিয়েভের সামরিক প্রত্যুত্তরের প্রাকৃতিক বিবর্তন এটি।
কিন্তু এক বছর আগের কথা চিন্তা করে দেখুন। রাশিয়ার ভেতরে হামলা চালানোর ধারণাটি নিয়েই কেমন সন্ত্রস্ত ছিলেন পশ্চিমারা কর্তৃপক্ষ। এ যুক্তিতে তখন ইউক্রেনকে দীর্ঘপাল্লার মিসাইল সরবরাহ করা হয়নি। কারণ ওসব মিসাইল দিয়ে ক্রিমিয়া বা ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী রাশিয়ান ভূমিতে হামলা চালাতে পারত কিয়েভ।
অথচ এখন প্রায় প্রতিদিনই ক্রিমিয়ায় হামলা হচ্ছে। আর এ ব্যাপারে পশ্চিমাদেরও বিশেষ কিছু বলার নেই, কারণ এসব হামলায় যেসব মিসাইল ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলো ইউক্রেনে তৈরি বলে মনে করা হচ্ছে।
সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার কিম জং-উন আর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠক হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, পিয়ংইয়ংয়ের কাছে গোলাবারুদ চেয়েছে মস্কো। তবে এ বৈঠকের ফলাফল কেবল তখনই জানা যাবে, যদি এসব অনুমানের কিছু আঁচ ইউক্রেনের রণক্ষেত্রে পাওয়া যায়।
যুদ্ধ-পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাওয়ার আরেকটি বড় ঝুঁকি রয়েছে। রোমানিয়া ও বুলগেরিয়ায় সম্প্রতি দুটি ঘটনায় ন্যাটোভুক্ত দেশের ভেতরে ড্রোনের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। এক বছর আগেও এমন ঘটনা কেউ কল্পানও করতে পারত না।
রাশিয়ার জনগণ তাদের যাপিত জীবনে এ লড়াইয়ের আঁচ টের পাচ্ছেন। অন্যদিকে পশ্চিমা জনগণের কাছে এটি অনেক দূরের একটি যুদ্ধ। রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনে এ যুদ্ধ সামগ্রিকভাবে ন্যাটোর বিরুদ্ধে রাশিয়ার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। অন্যদিকে ন্যাটোভুক্ত দেশের গণমাধ্যমে এ লড়াই রাশিয়ার ওপর বড় ও দীর্ঘস্থায়ী একটি আঘাত হানার সুযোগ যা কি না ন্যাটো বহির্ভূত একটি দেশ শুরু করেছে।
কিন্তু আগামী দুই মাসকে গুরুত্বহীন করে দেখার উপায় নেই ন্যাটোর কাছে। আসন্ন শীতেও রাশিয়া যদি দুর্বল না হয়, তাহলে আগামী দশকগুলো তা ইউরোপের নিরাপত্তার বড় ঝুঁকির কারণ হবে।