করোনার কারণে করা যায়নি আগাম উচ্ছেদ অভিযান
প্রতিবছর বর্ষা এলেই মৃত্যুর মিছিল বাড়ে পাহাড়ে পাদদেশে বসবাসকারীদের।
২০০৭ সালে ভয়াবহ পাহাড় ধসে ১২৯ জনের প্রাণহানির পর থেকে প্রতি বছরই বন্দর নগরী চট্টগ্রামে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের উচ্ছেদে তোড়জোড় দেখা যায়। করোনা মহামারীর কারণে বন্ধ রয়েছে সেই তোড়জোড়ও।
গত ফেব্রুয়ারিতে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের উচ্ছেদ অভিযানের সিদ্ধান্ত হলেও চার মাস পেরুলেও হয়নি তার বাস্তবায়নও।
এ বছরও বর্ষায় পাহাড় ধস হলে যথারীতি মাটিচাপায় প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। করোনা থেকে বাঁচতে পাহাড়েও লোকজন ঘরে থাকছে। তাই সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এবার পাহাড় ধস হলে প্রাণহানির ঘটনাও বেশি ঘটবে। ফলে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করেছে লক্ষাধিক মানুষ।
চলতি বছরের গত ৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বিভাগীয় কমিশনার এবিএম আজাদের সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন ও মন্ত্রণালয়ের সচিব জিয়াউল হাসানসহ সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা। এ সময় এক মাসের মধ্যে পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ সব ঘরের অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কামাল হোসেন বলেন, করোনার এ সংকটকালীন সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের কোথায় রাখা হবে সে বিষয় বিবেচনা করে এবার আগেভাগে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা যায়নি। যদি ভারীবৃষ্টিপাত শুরু হয় তাহলে আশ্রয়কেন্দ্রে তৈরি করে তাদের উচ্ছেদ করা হবে।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, চট্টগ্রামে ২৮টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে লোকজন বাস করছে। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ১৭টি পাহাড়ের মধ্যে সরকারি মালিকানাধীন সাতটিতে ৩০৪ পরিবার এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন অবশিষ্ট ১০ পাহাড়ে ৫৩১টি পরিবার বাস করছে।
সরকারি পাহাড়গুলোর মালিক চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, রেলওয়ে, ওয়াসা এবং গণপূর্ত ও জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এসব সংস্থাকে কখনও লোকজনকে উচ্ছেদে উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না।
নগরীর মতিঝর্ণা পাহাড় ও বাটালি হিলে দেখা যায়, দুটি পাহাড় কেটে নির্মাণ করা হয়েছে কাঁচা-পাকা বসতঘর। এই পাহাড়ে নির্মাণ করা হয়েছে চারতলা পাকা ভবনও। এসব ঘরে রয়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ। একটি মিটার থেকে ১০-১২ ঘরে দেওয়া হয়েছে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালী ও সংশ্নিষ্ট সেবা সংস্থাগুলোর অসাধু কর্মচারীদের সহযোগিতায় দীর্ঘদিন এ কাজটি চলছে।
কোন পাহাড়ে কত অবৈধ বসতি
১৭ পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে অবৈধভাবে বসবাস করা ৮৩৫ পরিবারের মধ্যে রেলওয়ের লেকসিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে ২২ পরিবার, পূর্ব ফিরোজ শাহ এক নাম্বার ঝিল সংলগ্ন পাহাড়ে ২৮ পরিবার, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মালিনাকানাধীন কৈবল্যধাম বিশ্ব কলোনি পাহাড়ে ২৮টি পরিবার, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন সিটি কর্পোরেশন পাহাড়ে ১০ পরিবার, রেলওয়ে, সওজ, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও ওয়াসার মালিকানাধীন মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল পাহাড়ে ১৬২ পরিবার, ব্যক্তি মালিকানাধীন একে খান পাহাড়ে ২৬ পরিবার, হারুন খানের পাহাড়ে ৩৩ পরিবার, পলিটেকনিক কলেজ সংলগ্ন পাহাড়ে ৪৩ পরিবার, মধুশাহ পাহাড়ে ৩৪ পরিবার, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংলগ্ন পাহাড়ে ৩৩ পরিবার, মিয়ার পাহাড়ে ৩২ পরিবার, আকবরশাহ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে ২৮ পরিবার, আামিন কলোনি সংলগ্ন ট্যাংকির পাহাড়ে ১৬ পরিবার, লালখান বাজার জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসা সংলগ্ন পাহাড়ে ১১ পরিবার, ভেড়া ফকিরের পাহাড়ে ১১ পরিবার, ফয়েজলেক আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়ে ৯ পরিবার এবং এম আর সিদ্দিকী পাহাড়ে আটটি পরিবার বসবাস করছে।
ঝুঁকিপূর্ণ যেসব পাহাড়
পরিবেশ অধিদফতরের হিসেবে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তির লোলুপ দৃষ্টিতে পড়ে চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে প্রায় ৩০টি পাহাড়। দিনে নয়তো রাতে এসব পাহাড় কেটে কেউ গড়ে তুলেছে জনবসতি, কেউ তুলছে দোকানপাট, কেউ তুলছে ইটভাটা, কেউবা গড়ছে শিল্প কারখানা, কেউ বানাচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্প, কেউ বানাচ্ছে সড়ক, কেউ বানাচ্ছে আবাসন।
পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির তালিকা অনুযায়ী চট্টগ্রামের ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো হচ্ছে- সলিমপুর বাস্তুহারা পাহাড়, টাইগারপাস-লালখান বাজার রোড সংলগ্ন পাহাড়, সিআরবি পাহাড়ের পাদদেশ, টাইগারপাস মোড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ, মোজাফফর নগর পাহাড়, কাট্টলি থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত পাহাড়, প্রবর্তক পাহাড়, গোলপাহাড়, ইস্পাহানী পাহাড়, বন গবেষণাগার ও বন গবেষণা ইনস্টিটিউট সংলগ্ন পাহাড়, জয়পাহাড়, চট্টেশ্বরী হিল, মতি ঝর্ণা ও বাটালি হিল সংলগ্ন পাহাড়, রেলওয়ে এমপ্লয়িজ গার্লস স্কুল সংলগ্ন পাহাড়, ফয়স লেক আবাসিক এলাকা পাহাড়, জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়, গরীবুল্লাহ শাহ মাজারের পাশের বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়, ডিসি হিলের চেরাগী পাহাড়ের দিকের ফুলের দোকান সমূহের অংশ, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন সিটি করপোরেশনের পাহাড়, একে খান অ্যান্ড কোং এর পাহাড়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন পাহাড়, কৈবল্যধামস্থ বিশ্ব কলোনির পাহাড়, মিয়ার পাহাড়, লালখান বাজার চান্দমারি রোড সংলগ্ন জামেয়াতুল উলুম ইসলামি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের পাহাড়, ফরেস্ট রিচার্চ ইনস্টিটিউট একাডেমির উত্তর পাশের মীর মোহাম্মদ হাসানের মালিকানাধীন পাহাড়, ইস্পাহানি পাহাড় সংলগ্ন দক্ষিণ পাশের হারুন খানের মালিকানাধীন পাহাড়ের পশ্চিমাংশ, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, লেক সিটি আবাসিক এলাকার পাহাড় ও সিডিএ এভিনিউ রোডের পাশে অবস্থিত বোসম গার্ডেন সংলগ্ন পাহাড়।
এই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল আমিন বলেন, চিরস্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা না হলে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের মৃত্যুর মিছিল বাড়বে। রাজনৈতিক আশ্রয় ছাড়া কারও পক্ষে পাহাড় দখল করে সেখানে অবৈধ বাসস্থান নির্মাণ করে ভাড়া দেওয়া অসম্ভব। পাহাড়ে যত মৃত্যু তার জন্য বেশিরভাগ দায়ী পাহাড়খেকোরা। এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা না গেলে সমস্যার সমাধান হবে না।