অবরোধে সরবরাহ চেইন ব্যাহত, বিক্রি কমেছে খাতুনগঞ্জে
দেশব্যাপী বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ডাকা অবরোধে মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) সারাদেশে নিত্যপণ্যের বেচা-বিক্রি ও আমদানি-রপ্তানি পণ্যের চলাচল ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে।
ব্যবসায়ীদের শঙ্কা, টানা তিন দিনের অবরোধে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক, বিরোধী দলীয় সমর্থক ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে উঠতে পারে; যা পুরো সরবরাহ চেইনকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতির ওপর। এতে করে দেশে চলমান বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এবং মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে কঠোর কর্মসূচি পালন করছে দেশের বিরোধী দলগুলো। আর এতে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বেড়েছে। চলতি বছরের শেষ কিংবা আগামী বছরের জানুয়ারির শুরুতে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
এদিকে ব্যবসায়ী নেতারা সতর্ক করেছেন, লাগাতার হরতাল ও অবরোধের মধ্যে ভয় এবং অনিশ্চয়তায় বন্ধ হয়ে যেতে পারে নিয়মিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে অর্থনীতি; ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা।
ঢাকায় অবরোধের উত্তাপ
রাজধানীর অন্যতম বৃহৎ পণ্যের বাজার কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য জেলা থেকে পণ্যবাহী ট্রাকগুলো সোমবার রাতে বা মঙ্গলবার ভোররাতে নিরাপদে ঢাকায় এসেছে। কিন্তু বুধবার (১ নভেম্বর) সকালেই বাজারে অবরোধের প্রভাব পড়বে বলে জানান তারা।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আশরাফুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সোমবার রাতে এখানে আসা ট্রাকগুলো অতিরিক্ত ভাড়া নেয়নি। তবে আজ রাতে আসা যানবাহনগুলো অবরোধের কারণে অতিরিক্ত ভাড়া নিতে পারে।"
সবজি ব্যবসায়ীরা জানান, অবরোধের কারণে ইতোমধ্যেই ট্রাকচালকরা ট্রাকপ্রতি ভাড়ায় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা বেশি দাবি করছেন।
অবরোধ কীভাবে প্রভাব ফেলছে রপ্তানি-আমদানি বাণিজ্যে?
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অবরোধ বন্দরের কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব ফেলেনি এবং যথারীতি জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করা হচ্ছে। তবে কমে গেছে পণ্য সরবরাহ।
অবরোধের কারণে পণ্য পরিবহন উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত হওয়ার ফলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পরিবহন ভাড়া ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা বন্দর থেকে পণ্য নিতে হিমশিম খাচ্ছেন।
দেশজুড়ে যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রতিকূল হয়ে উঠেছে দেশের রাস্তাঘাট। এমন অবস্থায় চালকেরাও যানবাহন নিয়ে রাস্তায় বের হতে শঙ্কিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েই অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করছেন পরিবহন শ্রমিকরা।
স্বাভাবিক সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর প্রতিদিন ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ কনটেইনার হ্যান্ডেল বা সরবরাহ করে এবং ৫,০০০ থেকে ৬,০০০ ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান এবং প্রাইম মুভার গ্রহণ করে।
তবে চলমান অবরোধের মধ্যে পরিবহন সংকট দেখা দেওয়ায় ভাড়া বাড়িয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা। অবরোধের প্রভাবে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকা পর্যন্ত কাভার্ড ভ্যানের ভাড়া দুই হাজার থেকে বেড়ে সাত হাজার টাকা হয়েছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, অবরোধ পণ্য পরিবহনে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব ফেলেছে, যার ফলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কাঁচামাল নিয়ে আসার জন্য যানবাহন জোগাড় ও ডিপোতে তৈরি পোশাক পণ্য পরিবহন করা একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে যানবাহনের ভাড়া প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে; এটি পোশাক প্রস্তুতকারকদের জন্য আর্থিক হুমকি।
অবরোধ দীর্ঘায়িত হলে পণ্য পরিবহনের খরচ আরও বাড়তে থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন পরিবহন নিশ্চিত করতে পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুতই ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ড ভ্যান এবং প্রাইম-মুভার ট্রান্সপোর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব চৌধুরী জাফর আহমেদ বলেন, সড়কে পুলিশের মসৃণ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার আশ্বাসের পরেও কিছু চালক অবরোধের কারণ দেখিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করছেন। এ সময়ে এটি রাস্তায় যানবাহন নিয়ে বের হতে চালকদের মধ্যে অনীহা প্রকাশ করছে। বিষয়টি উদ্বেগের।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, সাম্প্রতিক হরতাল দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য– বিশেষ করে, বন্দরের কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এরকম অবরোধ চলতে থাকলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে বলে সতর্ক করেছেন তারা; একইসঙ্গে দেশের সরবরাহ শৃঙ্খল যথাযথভাবে বজায় রাখতে পণ্য পরিবহনে প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
খাতুনগঞ্জে ৩০০ কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা
বিএনপি-জামায়াতের ডাকা অবরোধের প্রথম দিনেই ব্যবসায়িক লেনদেনে ধস নামে দেশের ভোগ্যপণ্যের প্রধান পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে। মহাসড়কে তেমন প্রতিবন্ধকতা না থাকলেও মঙ্গলবার বাজার থেকে দেশের জেলা-উপজেলা ও মোকামে পণ্যবাহী গাড়ির চলাচল ছিল খুবই কম। যার ফলে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে পণ্য বিকিকিনি কমপক্ষে ৬০-৭০ শতাংশ কম হয়েছে বলে জানান বাজারের ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতাদের।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী ও ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা জানিয়েছেন, দেশের অন্যতম বড় এ পাইকারি বাজারে দোকান, আড়ত ও গুদাম মিলে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। অবরোধের প্রথম দিনে ৭০-৮০ শতাংশ দোকান-পাট খুলেছে। তবে বিকিকিনি স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কমপক্ষে ৬০-৭০ শতাংশ কমে গেছে। এতে একদিনে খাতুনগঞ্জে নিট ক্ষতি হবে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সৈয়দ সগির আহমদ বলেন, "চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে বর্তমানে দিনে এক-দেড় হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের ডাকা অবরোধের প্রথম দিনেই সেই লেনদেন ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। এরকম চলতে থাকলে তিন দিনে কমপক্ষে হাজার কোটি টাকার বেচা-কেনা কম হবে"
খাতুনগঞ্জের পাইকারি ডাল ব্যবসায়ী হক ট্রেডিংয়ের স্বত্ত্বাধিকারী আজিজুল হক বলেন, বন্দর ও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিন ২৫০-৩০০ ট্রাক চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ও আসাদগঞ্জে আসে ভোগ্য পণ্য নিয়ে। আবার বিক্রি করা পণ্য পরিবহনের জন্য প্রতিদিন ট্রাক ও ঠেলাগাড়ি ঢুকে আরও কমপক্ষে ৩০০।
"কিন্তু অবরোধে দেশের জেলা-উপজেলা ও মোকামগুলো থেকে বাজারে ট্রাক ঢুকতে না পারায় আমরা অর্ডার নিয়েও পণ্য সরবরাহ করতে পারছি না। পণ্য ডেলিভারি করতে না পারলে দোকান খুলেও খুব বেশি লাভ হচ্ছে না," যোগ করেন তিনি।
আসাদগঞ্জের জামান এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী মোহাম্মদ কামরুজ্জামন বলেন, "খাতুনগঞ্জের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন লাখ টাকা থেকে কোটি টাকার লেনদেন লেনদেন হয়। কিন্তু অবরোধের কারণে আজ সকাল থেকে দূরের ব্যবসায়ীরা বাজারে আসেন নি। বিকিকিনি না থাকলে ঝুঁকি নিয়ে দোকান খুলে কি লাভ?"
তিনি আরো বলেন, ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে না পারলে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। তাই দেশের অর্থনীতির স্বার্থে হলেও সব দলের রাজনৈতিক নেতাদের একসাথে বসে চলমান সংকট সমাধান করা উচিত।
এদিকে, অবরোধের আগের রাতে অল্প সংখ্যক পণ্যবাহী গাড়ি বাজার থেকে মোকামে চলাচল করলেও বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা।
ভোমরা স্থল বন্দর থেকে আগে পণ্য পরিবহনে প্রতিট্রাকে ভাড়া দিতে হতো ৩৫-৩৮ হাজার টাকা। অথচ সোমবার এক ট্রাক পেঁয়াজ পরিবহনে ৪৫ হাজার টাকা ভাড়া গুনতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন গ্রামীণ বাণিজ্যালয়ের স্বত্ত্বাধিকারী বলায় কুমার পোদ্দার।