ইউএফও নিয়ে মার্কিন সরকারের তথ্য গোপনের বিষয় সত্য — তবে কারণ ভিন্ন
জন ব্রেনান সিআইএ-তে ২৫ বছর কাটিয়েছেন। তারপর হোয়াইট হাউজের হোমল্যান্ড-সিকিউরিটির উপদেষ্টা হন। সেখান থেকে আবারও ফেরেন সিআইএ-তে, এবার একেবারে পরিচালক পদে। তাই কোনো প্রশ্ন কখনো তার মনে উঁকি দিলে তিনি সেটার উত্তর খুঁজতে আমেরিকার সবচেয়ে তুখোড় সব বিশ্লেষক, অফিসার, সূক্ষ্ম সব নজরদারি নেটওয়ার্ক ও যন্ত্রপাতি অনায়াসে কাজে লাগাতে পারতেন।
তারপরও ২০২০ সালে এক ইন্টারভিউয়ে ব্রেনান বললেন, কাছাকাছি সময়ে কিছু ইউএফও (অজ্ঞাত উড়ন্ত বস্তু) দর্শনের ঘটনা নিয়ে তিনিও বিস্মিত; বিষয়গুলোর কোনো কূলকিনারা করতে পারছেন না। সে সাক্ষাৎকারে 'ভিন্ন ধরনের জীবনের' কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
ব্রেনানকে যে বিষয় হতবিহ্বল করেছে, সেটা নিয়ে একটু আগ্রহ পোষণ করাটা কখনো বৃথা যাবে না। এরপর আমার নতুন একটা বই লেখার কাজের অংশ হিসেবে আমি পরের দুই বছর মার্কিন সরকারের ইউএফও'র সঙ্গে জড়ানোর নানা ইতিহাস নিয়ে পড়ালেখা শুরু করি।
এ দুবছরে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হয়েছি, মার্কিন সরকার ইউএফও নিয়ে অনেক তথ্য গোপন রেখেছে, অনেক ঘটনা আড়াল করেছে — এসব দাবি সর্বৈব সত্য। তবে এ গোপনীয়তার কারণ আপনি যেটা ভাবছেন বা এতদিন ভেবে এসেছেন, তা নয়।
এখনো আমেরিকান সরকার গগন 'পরে ঘটা অনেক ঘটনা জনচক্ষুর আড়ালে রাখছে। তবে এসব লুকোচুরির পেছনে অপার্থিব কোনো কারণের চেয়ে পার্থিব কারণই বেশি শক্তিশালী বলে আমার বিশ্বাস। তথাকথিত 'অজ্ঞাত অস্বাভাবিক প্রপঞ্চ' বা ইউএপি (আনআইডেন্টিফায়েড অ্যানোমেলাস ফেনোমেনা; ইউএফও-এর নতুন নাম)-এর ঘটনা আড়ালে রাখার কিছু মৌলিক ও সুস্পষ্ট কারণ আছে।
মানুষের চোখে ধরা পড়া কিছু ইউএপি'র ঘটনা খুব সম্ভবত সরকারের বিভিন্ন গোপন প্রকল্প, প্রযুক্তি, বা অপারেশনের অংশ। সিআইএ'র তথ্যমতে, '১৯৫০-এর দশকে ইউএফও দর্শনের অর্ধেকের বেশি ঘটনা ছিল ইউ-২ ও অক্সকার্ট স্পাই প্লেনের পরীক্ষা ও উন্নয়নমূলক উড্ডয়ন'। বেশিরভাগ মানুষ যতটুকু ধারণা করেন, মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীগুলোর অধীনে তার চেয়ে বেশি গোপন টেস্ট ফ্লাইট, প্রকল্প, ও বিশেষ যান রয়েছে।
আর কিছু ইউএফও আদতে বিদেশি শক্তিগুলোর অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। মার্কিন বৈরীভাবাপন্ন দেশগুলো, যেমন রাশিয়া, চীন ও ইরান এসব প্রযুক্তি মার্কিন প্রতিরক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে পরীক্ষা করে। আর মার্কিন সরকারও এ ধরনের ঘটনায় কী জানা গেছে, আর কী জানা যায়নি তা প্রকাশ করতে চায় না।
কিছু কিছু সরকারি সংস্থা এসব বিষয়ে নিশ্চুপ থাকার একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, তাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকা। সরকারের অভ্যন্তর আদতে বিভিন্ন অপারেশন, গোপন প্রকল্প পরিচালনার গোলকধাঁধা। এ বিষয়গুলো দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। তাই সরকারের কোনো একক সত্তা বা একজন আমলা পুরোপুরি কখনোই জানতে পারেন না যে অন্যরা কী করছে।
১৯৪৮ সালে একবার ইউএফও দেখার খবর শুনে এয়ার ফোর্সের ক্যাপ্টেন টমাস ম্যানটেলকে পাঠানো হয় বস্তুটির পেছনে। কিন্তু উড্ডয়নের এক পর্যায়ে তার বিমান বিধ্বস্ত হয়। সামরিক অফিসারেরা কিছুই বুঝতে পারছেন না: তবে কি কোনো ইউএফও মার্কিন যুদ্ধবিমানকে ভূপাতিত করল?
১৯৫০-এর দশকে এসে এ ধোঁয়াশার উত্তর মিলল। মার্কিন বিমানবাহিনীর ইউএফও গবেষণা বিষয়ক ইউনিট প্রজেক্ট ব্লু বুক সিদ্ধান্তে পৌঁছাল, ম্যান্টেল যে 'ইউএফও'-এর পেছনে তাড়া করছিলেন সেটা ছিল আদতে নৌবাহিনীর গোপন একটি গবেষণা বেলুন। তখন পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন করা হচ্ছিল বেলুনটির।
তবে আমার মনে হয় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার চেয়েও বড় বিষয় জড়িয়ে আছে ইউএফও বিষয়ক এ ধরনের গোপনীয়তায়। সরকার সব ধরনের বিষয়েই নিয়মিত তথ্য গোপন রাখে। সরকারের মৌলিক অবস্থানই হলো দরকার ছাড়া বেশি তথ্য বাইরে প্রকাশ না করা — বিশেষ করে কখনো যেন এমন তথ্য বাইরে বেরিয়ে না পড়ে যার জন্য সরকারকেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। সরকারি নথিপত্র পড়ে আমার যা মনে হলো, সরকার আসলে নিজেই খুব বেশি জানে না।
সরকারি কর্মকর্তারা নিজেরাই স্পষ্টভাবে জানেন না যে ইউএফও বা ইউএপি আদতে কী। আর তারা সেটা বলে বেড়াতে চান না, পছন্দ করেন না। হাজার হোক, কোনো সরকারি বড়কর্তা যদি বলেন, 'আমি তো জানি না' — জনগণের কাছে সেটা ভালো লাগবে না। কারণ মার্কিন সরকার নিজেদের অভ্যন্তরীণ ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বছরে ৯০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করে। তাই অত পয়সার বিনিময়ে জনগণ স্রেফ 'না' শুনতে চাইবে না।
১৯৬৬ সালে ফ্রিডম অভ ইনফরমেশন অ্যাক্ট চালু হয়। তার আগের সময়ের লেখা বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, অনেক ইউএফও দেখার ঘটনায় স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। প্রজেক্ট সাইন-এর আওতায় ২৭৩টি ইউএফও-দর্শন ঘটনা বিশ্লেষণ করা হয়।
ওই প্রজেক্টের গোপন একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশিরভাগ ঘটনা মানবীয় মন ও দর্শনেন্দ্রিয়ের ভুলের কারণ। আবার কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে মানুষ সাধারণ বায়ুযানকে ভুল বস্তু হিসেবে ভেবেছিলেন। তবে ওই রিপোর্টে সবগুলো ঘটনা ব্যাখ্যা করা যায়নি বলে জানানো হয়।
১৯৫৩ সালে সিআইএ ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অভ টেকনোলজি (ক্যালটেক)-এর পদার্থবিদ হাওয়ার্ড পি. রবার্টসনকে প্রধান করে রবার্টসন প্যানেল নামক একটি ইউএফও গবেষণা গ্রুপ তৈরি করে। ওই প্যানেল সিদ্ধান্তে আসে যে, ইউএফও মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি নয়। তবে এ প্যানেলও সবগুলো ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।
বিভিন্ন পর্যবেক্ষকদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সবগুলো দর্শনের মধ্যে সাধারণত ৫–২০ শতাংশ ঘটনা কখনোই ব্যাখ্যা করা যায়নি। তবে এগুলোর অনেকগুলো ব্যাখ্যা না করার কারণ হলো এসব দর্শনের ঘটনা ব্যাখ্যার জন্য পর্যাপ্ত কোনো ডেটা নেই। তবে কিছু ঘটনা সত্যিই রহস্যের চাদরে ঢাকা।
মার্কিন সরকারের সঙ্গে ইউএফও গবেষণা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অনেক বিশ্লেষক বিরক্ত ও হতাশও হয়েছিলেন। তাদের একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী জে. অ্যালেন হাইনেক। তিনি প্রজেক্ট সাইন ও প্রজেক্ট ব্লু বুক-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, 'দু ধরনের গোপনীয়তা আছে। আপনি জ্ঞান লুকাতে পারেন, অথবা অজ্ঞতা। আমার মনে হয়, এখানে (ইউএফও বিষয়ক অনুসন্ধানে) জ্ঞানের চেয়ে অজ্ঞতাই বেশি জড়িত।'
হয়তো অনেক ইউএপি-দর্শন ঘটনারই বিশ্বাসযোগ্য কোনো না কোনো ব্যাখ্যা আছে। সেগুলো হতে পারে গোপন প্রজেক্ট, বৈরী প্রযুক্তি, মহাশূন্যের আবর্জনা ইত্যাদি। কিন্তু এ কথা প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, উড়ন্ত এসব অজানা বস্তুর ক্ষেত্রে কিছু না কিছু যুগান্তকারী ব্যাপার তো আছেই। এগুলো ভালোমতো তদন্ত করলে হয়তো বায়ুমণ্ডল, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞানের নতুন কোনো প্রপঞ্চ জানা যাবে। হয়তো আকাশে সত্যিই এমন বস্তু আছে যেগুলো সম্পর্কে আমরা এখনো কিছুই জানিনা।