কমেছে দূষণ, হালদায় খেলছে ডলফিন
করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে প্রায় থমকে আছে দেশ। সাধারণ ছুটির কারণে টানা বন্ধ ছিলো কল-কারখানাগুলো। ফলে কমেছে দূষণ। সেই সুবাধে প্রকৃতি যেন ফিরে পেয়েছে তার নিজের রূপ।
এর আগে, প্রায় তিন দশক পর বিশ্বের সর্বৃবহৎ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে দেখা মিলেছিল ডলফিনের। আর এবার বিশ্বের অন্যতম বিপন্ন স্তন্যপায়ী গাঙ্গেয় ডলফিনকে খেলা করতে দেখা গেলো চট্টগ্রামের হালদা নদীতে। স্থানীয়ভাবে এই প্রাণীকে শুশুকও বলা হয়।
শুক্রবার দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাকৃতিক মৎস প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে অভিযানে গিয়ে ডলফিনগুলোকে খেলা করতে দেখেন হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুহুল আমিন। নদীর ইন্দিরা ঘাট থেকে ৫০০ গজ দূর এলাকায় এসব ডলফিনের দেখা মিলেছে।
ইউএনও রুহুল আমিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "হালদায় নিয়মিত অভিযান করি। অভিযানে গেলে মাঝেমধ্যে ডলফিন চোখে পড়ে। তবে সেসময় এসব ডলফিনকে খেলা করতে দেখা যেতো না, নৌকা চলাচল টের পেয়ে ছোটাছুটি করতো। তবে আজকে একসঙ্গে পাঁচ থেকে ছয়টি ডলফিনকে খেলতে দেখলাম।"
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত হালদায় ২৫টি ডলফিন মারা গেছে। দূষণ, ইঞ্চিন চালিত নৌকা চলাচল, জালে আটকে এসব ডলফিন মারা যাচ্ছে বলে ধারণা গবেষকদের। বিপন্ন প্রজাতির এসব ডলফিন রক্ষা নিয়ে তাই তাদের দুশ্চিন্তা।
ইতোমধ্যে হালদায় থাকা গাঙ্গেয় (প্লাটানিস্টা গাঙ্গেটিকা) প্রজাতির ডলফিনকে বিপন্ন প্রাণী হিসেবে লাল তালিকাভুক্ত করেছে প্রকৃতি সংরক্ষণের সংস্থা আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন)।
এদিকে দূষণ কমে যাওয়াকে ডলফিনের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন গবেষকরা।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া শুক্রবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "করোনার কারণে সবকিছু বন্ধ হওয়ার ফলে হালদায় দূষণ কমেছে। এবার মাছের ডিম আহরণে সংখ্যা সেটি বলে দিয়েছে। গত ১০ বছরের মধ্যে এবার সর্বোচ্চ ডিম পাওয়া গেছে। শুক্রবার ডলফিনগুলো খেলা করার ছবি আমি দেখেছি। এগুলো বড় ও মাঝারি আকারের ডলফিন। দূষণ কমার কারণে এখন আগের তুলনায় ডলফিনের বিচরণ বেড়েছে।"
ইতোমধ্যে দূষণ কমার সুফল ঘরে তুলেছে হালদা থেকে ডিম আহরণকারীরা। চলতি বছর হালদা থেকে রেকর্ড পরিমাণ রুই জাতীয় মাছের ডিম আহরণ হয়েছে।
মূলত ২০১৯ সালে হাটহাজারীর এশিয়ান পেপার মিল ও পিকিং বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া পর থেকে হালদায় দূষণ কমতে শুরু করে। এশিয়ান পেপার মিল ও পিকিং বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্য সরাসরি হালদায় পড়তো বিধায় প্রতিষ্ঠানটি দুটিকে হালদা দূষণের জন্য দায়ী করা হতো।
এ ছাড়া বালু উত্তোলন যন্ত্র ধ্বংস, অবৈধ কারেন্ট জাল জব্দে বহুবার সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করছে প্রশাসন।
২০১৯ সালে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউএনডিপির সহযোগিতায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি ও বাংলাদেশ বনবিভাগের এক সমীক্ষায় হালদায় মাত্র ৪৫টি ডলফিনের পাওয়া গিয়েছিল।
তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী, হালদা নদীতে ডলফিনের সংখ্যা প্রায় ১৭০টি। পাশাপাশি নদীতে থাকা ডলফিনগুলো নিয়মিত বাচ্চাও দিচ্ছে।
অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া আরও বলেন, "গঙ্গা ও এর শাখা নদীগুলোতে এই প্রজাতির ডলফিন দেখা যায়। এগুলো পরিষ্কার পানির ডলফিন। একসময় বাংলাদেশের অনেক নদীতে এই প্রজাতির ডলফিন দেখা যেতো। তবে দূষণের কারণে গাঙ্গেয় প্রজাতির ডলফিন দেশের বিভিন্ন নদী থেকে হারিয়ে গেছে। কিন্তু হালদায় এখনো অনেকগুলো গাঙ্গেয় ডলফিন রয়েছে। নানা কারণে ডলফিন মারা গেলেও বেঁচে থাকা ডলফিনগুলো বাচ্চা দিচ্ছে। তবে আমাদের কাছে আপডেট কোনো হিসেবে নেই।"
এদিকে লকডাউনের মধ্যে হালদা থেকে একাধিক মৃত ডলফিন উদ্ধারের পর গত ১৯ মে হালদা নদীর জীব বৈচিত্র্য, মা মাছ ও ডলফিন রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বিশেষ একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন হাইকোর্ট।
কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। ভার্চুয়াল মিটিংও হয়েছে।