বগুড়া-৭ আসন: ভাগ্যের ফেরে এমপি, শূন্য থেকে স্বামী-স্ত্রী কোটিপতি
সাজাপ্রাপ্ত আসামি হওয়ায় ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়া-৭ আসনে খালেদা জিয়া অংশ নিতে না পারায় এবং মনোনয়ন নিয়ে জটিলতা দেখা দেওয়ায় সে বার আসনটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল করিম বাবলু ওরফে শওকত আলী গোলবাগীকে সমর্থন দেয় বিএনপি। ফলে এক রাতের ব্যবধানে সংসদ হন তিনি। এরপর একদম শূন্য থেকেই কোটিপতি বনে যান বাবলু ও তার স্ত্রী।
বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনটি 'জিয়া পরিবারের আসন' হিসেবে পরিচিত। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মস্থান গাবতলী ও পাশের উপজেলা শাজাহানপুর নিয়ে এ আসনে ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সব জাতীয় নির্বাচনেই বিপুল ভোটে বিজয়ী হন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
কিন্তু সাজাপ্রাপ্ত আসামি হওয়ায় ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি খালেদা জিয়া। এখানে বিএনপির মনোনয়ন পান দলের গাবতলী উপজেলা শাখার নেতা মোরশেদ মিলটন। তখন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগপত্র গৃহীত না হওয়ায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়। আসনটি বিএনপিশূন্য হয়ে যায়।
এখানে আওয়ামী লীগেরও প্রার্থী ছিল না। মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিকে আসনটি ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। তবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বড় অংশ ছিল স্বতন্ত্র প্রার্থী ফেরদৌস আরা খানের পক্ষে। তিনি গাবতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতির আজম খানের স্ত্রী এবং শহর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক রফি নেওয়াজ খানের শাশুড়ি।
এই অবস্থায় ভোটের এক দিন আগে স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল করিম বাবলুকে সমর্থন দেয় স্থানীয় বিএনপি। ফলে এক রাতের ব্যবধানে সংসদ হন বাবলু। বগুড়া-৭ (গাবতলী-শাজাহানপুর) আসনে সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু ওরফে শওকত আলী গোলবাগী।
পাঁচ বছর আগে বাবলুর স্ত্রী বিউটি বেগমের নিজের নামে এক টাকাও ছিল না। কিন্তু এখন তার অবস্থা আর সেরকম নেই। বর্তমানে তিনি সোয়া কোটি টাকার মালিক। আছে ১ হাজার বর্গফুটের একটি দালান। এর দামই ১ কোটি ১ লাখ টাকার উপরে। শূন্য থেকে তার কোটিপতি হওয়া সম্ভব হয়েছে স্বামী শওকত আলী গোলবাগীর বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য হওয়ার সুবাদে।
আর পরিবর্তন যে বাবলুর স্ত্রীর শুধু হয়েছে তা নয়। পাঁচ বছর আগে বাবলু হলফনামায় উল্লেখ করেছিলেন, তার বার্ষিক আয় ৫ হাজার টাকা। ভোটে দাঁড়ানোর আগে জমা টাকা ছিল ৩০ হাজার। চলাফেরা করতেন একটি পুরোনো মোটরসাইকেলে।
এখন প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বর্তমানে তিনি দুটি গাড়িতে চড়েন। একটি নিশান এক্সট্রেইল জীপ। অন্যটি ল্যান্ডক্রুজার। দুটির দাম এক কোটি ৪ লাখ ৪৫ হাজার। সব মিলে বর্তমানে তার সম্পদ ১ কোটি ৬৪ লাখ ৩৯ হাজার ৩৩৫ টাকা।
এসএসসি পাস বাবলু দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে কমিশনে দেওয়া হলফনামায় নিজের পেশা ইট, বালু, সিমেন্টসহ অনলাইন ব্যবসা উল্লেখ করেছেন। একাদশে জমা দেওয়া হলফনামায় তার পেশা লেখা ছিল ব্যবসা ও সাংবাদিকতা। তখন তার ও তার ওপর নির্ভরশীল বার্ষিক আয় ৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ সাংসদ হওয়ার আগ পর্যন্ত তার মাসিক আয় ছিল ৪১৭ টাকা।
বর্তমানে তার ও তার ওপর নির্ভরশীল বার্ষিক আয় ৩৬ লাখ ২৪ হাজার ৩৩৫ টাকা। অর্থাৎ এখন তার মাসে আয় তিন লাখ ২ হাজার ২৮ টাকা। এই হিসেবে তার আয় বেড়েছে ৭২৪ গুণেরও বেশি।
পাঁচ বছর আগে তার হলফনামায় আয়ের উৎস বলা হয়েছিল কৃষি ও ব্যবসা। এর মধ্যে কৃষি খাত থেকে বছরে আসে ৩ হাজার টাকা। আর ব্যবসা থেকে বছরে আয় ২ হাজার টাকা। নির্বাচনের আগে তার কাছে নগদ টাকা ছিল ৩০ হাজার। ব্যাংকে জমার পরিমাণও ৩০ হাজার টাকা। তার মোটরসাইকেলের মূল্য ৫০ হাজার টাকা উল্লেখ ছিল।
তবে এবার জমা দেওয়া তার হলফনামা বলছে ভিন্ন কথা। এবার কৃষি খাতে তার কোনো আয় নেই। বাড়ি ভাড়া থেকে পান ১ লাখ ৮০ হাজার। ইট, বালু, সিমেন্ট ও অনলাইন ব্যবসা থেকে বছরে আয় ১১ লাখ ১৫ হাজার টাক। এমপি হিসেবে প্রাপ্ত আয় ও আনুতোষিক ২৩ লাখ ২৪ হাজার ২২৫ টাকা।
পাঁচ বছর আগে তার নগদ টাকা ছিল ৩০ হাজার। বর্তমানে তার নিজ নামে সাড়ে পাঁচ লাখ আছে। ব্যাংকে ছিল ৩০ হাজার। এবার অবশ্য ব্যাংকে তার কোনো টাকা নেই। সংসদ সদস্য হওয়ার আগে তার ৫০ হাজার টাকা দামের গাড়ি ছিল। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তিনি এক কোটি ৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা দামের দুটি বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেন।
পাঁচ বছর আগে বাবলুর কাছে ৬ ভরি স্বর্ণ ছিল। তবে এবার তার কাছে কোনো স্বর্ণ নেই। তার স্ত্রী বৈবাহিক সূত্রে ১০ ভরি স্বর্ণ পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু পাঁচ বছর আগে তার স্ত্রীর নামে এই স্বর্ণের কোনো তথ্য তিনি হলফনামায় উল্লেখ করেননি।
পাঁচ বছর আগে সংসদ সদস্য বাবলুর ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী ছিল ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এবার এখানে তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। পাঁচ বছর আগে তার আসবাবপত্র ছিল দেড় লাখ টাকার। এবারও এই সম্পদের পরিমাণ একই বলে হলফনামায় তুলে ধরা হয়েছে।
পাঁচ বছর আগে অন্যান্য খাতে রেজাউল করিম বাবলু টাকা ছিল ৩০ হাজার। এবার অন্যান্য খাতে কিছু উল্লেখ করেননি।
স্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে পাঁচ বছর আগে তার কৃষি জমির পরিমাণ ছিল ৪৫ শতক। এবার তিনি কৃষি জমির কথা উল্লেখ করেননি। সংসদ সদস্য হওয়ার আগে তিনি অকৃষি জমির আর্থিক মূল্য উল্লেখ করেছিলেন ৪৫ লাখ টাকা। এবারের হলফনামায় তিনি বলেছেন, তার ৩৫ হাজার টাকা মূল্যের অকৃষি জমি রয়েছে।
পাঁচ বছর আগে নিজের নামে বাবলুর ৫ লাখ টাকার দালান ছিল। এবার অবশ্য সে দালানের কোনো হদিস নেই হলফনামায়। তার স্ত্রীর নামে ১ কোটি ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার আবাসিক ভবন থাকার কথা বলেছেন হলফনামায়। পাঁচ বছর আগে স্ত্রী বিউটি বেগমের নামে কোনো আবাসিক দালান ছিল না।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে রেজাউল করিম বাবলুর কোনো বাড়ি বা এপার্টমেন্ট ছিল না। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য জমা দেওয়া হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেছেন তার নামে ১৫ লাখ টাকার একটি এপার্টমেন্ট রয়েছে।
পাঁচ বছর আগে তার স্ত্রীর নামে কোনো সম্পদ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে তিনি নগদ ২ লাখ ৫০ টাকার মালিক। আছে তিন লাখ টাকার মূল্যের একটি মোটরসাইকেল। ১০ ভরি স্বর্ণেরও মালিক তিনি। যদিও পাঁচ বছর আগে তার নামে এক আনা স্বর্ণের কথাও উল্লেখ ছিল না।
নিজের ও স্ত্রীর নামে সম্পদের উৎসের প্রশ্নে রেজাউল করিমকে প্রশ্ন করা হলে বলেন, "আমার দাখিলকৃত আয়করের হিসাব অনুযায়ী হলফনামায় তথ্য দেওয়া হয়েছে। এসব তথ্যের যাবতীয় ব্যাখা দেওয়া আছে।"
স্ত্রীর নামে কোনো ব্যবসা আছে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "এগুলোর সব ব্যাখ্যা হলফনামায় দেওয়া আছে।"
এবার বগুড়া-৭ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া ২৫ জনের মধ্যে ১৬ জনই স্বতন্ত্র।