ইলিশ উৎপাদনে রেকর্ডের হাতছানি
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে টানা ৬৬ দিন বরিশাল-ঢাকা নৌপথে বন্ধ ছিল লঞ্চ চলাচল। নদী তীরবর্তী অনেক শিল্প কারখানাও এ সময় ছিল বন্ধ। যান্ত্রিক নৌযান চলাচল ও বেশিরভাগ শিল্প কারখানা বন্ধ থাকায় বরিশাল বিভাগের নদ-নদীতে দূষণ হয়েছে কম। পাশাপাশি করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছিল বিভিন্ন জেলায়। তাই নদীতে মাছ শিকারে যেতে পারেননি অনেক জেলে।
ফলে নদীতে বাধাহীন চলাফেরা করতে পেরেছে ইলিশের ঝাঁক। দূষণ কম হওয়ায় ইলিশের বেড়ে ওঠা ও বংশবিস্তার ঘটেছে নির্বিঘ্নে।
এসব দিক বিবেচনা করে ইলিশ উৎপাদনে আশার আলো দেখছেন বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং মাছ বিষয়ক সংস্থাগুলোর গবেষক ও জেলেরা। তাদের তথ্যমতে, এবার ইলিশের উৎপাদন ভাঙবে অতীতের সব রেকর্ড।
তাদের অভিমত, করোনার কারণে দু'মাসের বেশি সময় লঞ্চ চলাচল ও বেশিরভাগ শিল্প কারখানা ছিল বন্ধ। পাশাপাশি লকডাউনের কারণে মানুষের আর্থিক ক্ষতি বেশি মাত্রায় হলেও তার প্রভাব পড়েছে পরিবেশেও। বাতাসে দূষণের মাত্রা কমেছে। কমেছে নদী দূষণ। সেই প্রভাব পড়েছে ইলিশের ওপরে।
লকডাউনের জেরে ওই সময় বেশিরভাগ জেলে মাছ না ধরায় ইলিশের বংশবৃদ্ধি হয়েছে। অনেকটা অবাধে নদ-নদী ও সমুদ্রে বিচরণ করতে পেরেছে ইলিশ। পাশাপাশি বেড়ে ওঠার সময়ও পেয়েছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তা (ইলিশ) ড. বিমল চন্দ্র দাস জানান, গত কয়েক বছর দেশে ইলিশের আহরণ বেড়েছে। বড় আকারের ইলিশও জেলেদের জালে ধড়া পড়ছে। আগে এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ বাজারে খুব কমই দেখা যেত। দামও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে ছিল।
'এ বছর শীতেও বাজারে প্রচুর বড় ইলিশ বিক্রি হয়েছে। ইলিশের গড় ওজন গত তিন বছরে ৩৫০ গ্রাম বেড়েছে। শুধু আকার ও ওজন নয়, মোট উৎপাদনও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হয়েছে,' বলেন তিনি।
এসবের মূল কারণ, সাগরে নির্দিষ্ট সময় মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন, অভয়াশ্রমগুলোতে জাটকা ধরা বন্ধ এবং নিষিদ্ধ সময়ে মা ইলিশ ধরা বন্ধ করার কারণে ইলিশের উৎপাদন দিনে দিনে বেড়েছে। তবে এবার করোনার কারণে টানা ৬৬ দিন বরিশাল-ঢাকা নৌপথে বন্ধ ছিল লঞ্চ চলাচল।
বিমল চন্দ্র দাস জানান, দেশের ছয়টি অভয়াশ্রমের চারটি রয়েছে বরিশাল বিভাগে। ৬৬টি দিন লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় অভয়াশ্রম চারটিসহ বিভাগের বিভিন্ন নদ-নদীতে ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ অবাধে বিচরণ করতে পেরেছে। লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় পানিতে দূষণ কমেছে। এতে ইলিশের বংশবিস্তার ও প্রজননসহ সব কিছুই বাড়বে বলে ধারণা করছি।
শুধু তা-ই নয়, হারিয়ে যাওয়া দেশীয় প্রজাতির অনেক মাছ আবার নতুন করে নদীতে ফিরে আসতে পারে বলে মনে করছেন তিনি।
ভোলার দৌলতখান উপজেলার জেলে মো. জসিম বলেন, বিশ বছর ধরে নদীতে ইলিশ মাছ ধরছি। এ ধরনের পরিস্থিতি আগে দেখিনি। লকডাউনের কারণে অনেক দিন নদীতে জাল ফেলতে পারিনি। অভিজ্ঞতা বলছে, আসন্ন মৌসুমে বেশি ইলিশ মাছ পাওয়া যাবে।
বরিশাল পোর্ট রোডের আড়তদার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অজিত কুমার দাস মনু জানান, নদ-নদীতে তেমনভাবে এখন ইলিশ ধরা পড়ছে না। অল্পকিছু ইলিশ জেলেদের জালে আসছে। এজন্য বাজারে ইলিশের আকাল চলছে।
'গত বছর এ সময় বাজারে অনেক ইলিশ উঠলেও এবার ভিন্ন চিত্র। কয়েকদিন ধরে কিছু ইলিশ আসছে, সেগুলোর দামও বেশি। ইলিশের এই অবস্থা ভাবাই যায় না! জেলেদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে,' বললেন অজিত কুমার।
তিনি জানান, তবে সবাই আশায় রয়েছেন। সমুদ্রে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে এই সংকট কেটে যাবে। তখন ট্রলার ভর্তি করে মোকামে ইলিশ আসবে। ইলিশের দাম কমবে। ক্রেতারাও ইচ্ছেমতো কম দামে ইলিশ কিনতে পারবেন।
মৎস্য অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আজিজুল হক জানান, ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা খুবই কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত। পাশাপাশি করোনার বিস্তার রোধে লকডাউন ও দুই মাসের বেশি সময় যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ ছিল।
তিনি জানান, দেশে ইলিশ উৎপাদনের বড় অবদান বরিশাল বিভাগের। কয়েক বছর ধরেই দেশের মোট ইলিশের ৬৬ ভাগের বেশি আহরিত হচ্ছে এ বিভাগ থেকে।
মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণের পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে চার দশমিক ১৯ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। সে অনুযায়ী বরিশালেও তা প্রায় আট হাজার টন বৃদ্ধি পায়। দেশে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ইলিশ আহরিত হয় পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ১৮৮ টন। এরমধ্যে বরিশাল বিভাগ থেকেই আহরিত হয়েছিল তিন লাখ ৩২ হাজার ২৫ টন।
বরিশাল বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইলিশের জোগান দেয় ভোলা ও বরগুনা। ভোলায় গত অর্থবছরে ইলিশ আহরিত হয় এক লাখ ৬১ হাজার ৮৩২ টন ও বরগুনায় ৭০ হাজার ২৩৭ মেট্রিক টন। এছাড়া পটুয়াখালীতে ৪৮ হাজার ২৮৭ টন, বরিশালে ৪১ হাজার ৪৫৯ টন, পিরোজপুরে পাঁচ হাজার ৭১৫ টন ও ঝালকাঠিতে আহরিত হয়েছিল এক হাজার ৪৯৫ টন। চলতি অর্থবছরে তা আরও বাড়বে।
আজিজুল হক বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, এ বছর ইলিশ উৎপাদনে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। দেশে এবার এক লাখ টন ইলিশ বেশি আহরনের সম্ভাবনা রয়েছে। এরমধ্যে বরিশাল বিভাগেই ৬০ থেকে ৭০ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ বেশি আহরিত হবে বলে আশা করছি।