ধীর গতির চীনা ঋণে যেভাবে প্রকল্প ব্যয় বাড়ে
সরকার থেকে সরকারের (জিটুজি) পর্যায়ে চুক্তির একটি প্রকল্প: ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে প্রজেক্ট' ২০১৭ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশের শীর্ষ অর্থনৈতিক কর্তৃপক্ষ একনেক- এর অনুমোদন পায়। এ প্রকল্পে বাজেট থেকে বরাদ্দ রাখা হয় ১৬ হাজার ৯০১ কোটি টাকা।
প্রকল্পের অর্থায়ন চুক্তিতে চায়না এক্সিম ব্যাংক ১.১ বিলিয়ন ডলার বা ৯ হাজার ৪৭২ কোটি টাকার তহবিল অনুমোদন দেয়। ব্যয়ের বাকি অংশ নির্বাহ করবে বাংলাদেশ। তবে অনুমোদনের চার বছর পরে ২০২১ সালের অক্টোবরে চায়না এক্সিম ব্যাংকের সাথে ঋণচুক্তি হয় সরকারের।
ঋণচুক্তি করতে এই বিলম্বের কারণে মূল্যও দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে, কারণ এই চার বছরে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে গেছে ৬২৫ কোটি টাকা।
ঋণচুক্তি চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় এ ধরনের ধীরগতির ফলে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে ও বাস্তবায়ন পেছাচ্ছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-র মতে, চীনের ২.৪৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য নির্ধারিত পাঁচ প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হতে পারে।
ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেন, 'চীন ৩ শতাংশ সুদহারের প্রস্তাব দিয়েছিল। সুদ-সংক্রান্ত আলোচনায় কারণে ঋণ চুক্তি হতে সময় লেগেছে। প্রায় এক বছর আলোচনার প্রেক্ষিতে ২ শতাংশ সুদ নির্ধারণ হয়।'
তবে চুক্তি পর ঋণ কার্যকর হতেও সময় লাগে। 'ঋণটি কার্যকর হয় ২০২২ সালের ১০ মে। ফলে অনুমোদনের পরে বাস্তবায়ন কাজ শুরু করতেই প্রায় ৫ বছর লেগেছে। দেরিতে বাস্তবায়ন কাজ শুরু হওয়ার এই প্রকল্পের বর্তমান ভৌত অগ্রগতি ১২ শতাংশ'- বলে জানান তিনি।
রাজশাহী ওয়াসা সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান' শীর্ষক আরেকটি প্রকল্প অনুমোদন পায় ২০১৮ সালের অক্টোবরে। কিন্তু, এর ৫৫ মাস পরে এই বছরের ১০ মে মাসে চীনের সাথে ২৭৬.২৫ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছে।
এই প্রকল্পের পরিচালক, পারভেজ মামুদ বলেন, প্রকল্পটি ২০২২ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, সময়মতো ঋণচুক্তি না হওয়ার কারণে প্রকল্প বিল্মবিত হয়েছে। 'প্রকল্পটি এখন শেষ করতে ২০২৭ সাল পর্যন্ত লাগবে।'
চীনের অর্থায়নে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পও অনুমোদনের দুই বছর পর ঋণ চুক্তি হয়।
ঋণ চুক্তিতে দেরি হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে ইআরডির সিনিয়র একজন কর্মকর্তা জানান, মূলত চীনা পক্ষের কারণেই এমনটা হচ্ছে। বিলম্বের নানান কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে– ঋণ চুক্তির অধীনে থাকা প্রকল্পগুলোর পর্যালোচনা।
দীর্ঘ পর্যালোচনা প্রক্রিয়া
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে ঋণচুক্তির দ্রুত প্রক্রিয়ার তুলনায়– ঋণ অনুমোদন দিতে দীর্ঘ সময় নেয় চীন।
তাঁরা বলেন, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বা জাইকার মতো বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীদের প্রকল্প সাধারণত একনেকে অনুমোদনের মাসখানেকের মধ্যে চুক্তি হয়ে যায়। এর বিপরীতে, অনেক সময় নিয়ে প্রকল্প প্রস্তাব এবং ঋণ প্রস্তাব পর্যালোচনা করে চীন।
চীনের ঋণ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধাপ রয়েছে। এরমধ্যে শুরুতে কোন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চীনকে প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। চীন তখন প্রকল্প প্রস্তাব চায়, এরপর সেটিকে অনুমোদন দিলে, পরের পর্যায়ের কাজ শুরু হয়।
এরপর চীন প্রকল্পের ওপর বিস্তৃত সমীক্ষা ও বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিক ঋণ প্রস্তাব চায়। ঋণ অনুমোদনের আগে একের পর এক এসব ধাপ সম্পন্ন হতে সাধারণত ২ থেকে ৩ বছর লেগে যায়। এরপর চুক্তি সই হলেও, তহবিল পেতে আরও এক বছর লাগে।
ইআরডির একজন সিনিয়র কর্মকর্তার মতে, 'বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীদের প্রকল্পে সরকারের অনুমোদন প্রক্রিয়া এবং ঋণ প্রক্রিয়া সমান্তরালভাবে হয়। যে কারণে সরকারের অনুমোদন পাওয়া পর পর ঋণ চুক্তি হয়ে যায়। তাছাড়া, চীন বিভিন্ন দেশকে ঋণ দেয়। সেক্ষেত্রে একসঙ্গে বাংলাদেশে একাধিক প্রকল্পে অর্থায়ন দেওয়া সম্ভব হয় না। সাধারণত দেখা যায়, বাংলাদেশকে বছরে একটি প্রকল্পে ঋণ দেয় দেশটি' - যোগ করেন তিনি।
বিলম্বিত ঋণচুক্তি
ডিজিটাল সংযোগ স্থাপন এবং ছয়টি জাহাজ ক্রয়- বর্তমানে এ দুটি প্রকল্পে ঋণ পেতে চীনের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ইআরডি।
চীন বছরে সাধারণত একটি করে প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়ায়, এই অর্থবছরেই একটি ঋণচুক্তি হতে পারে। অন্য প্রকল্পগুলোর জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
সারা দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপনের জন্য 'ডিজিটাল সংযোগ প্রকল্পটি ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর অনুমোদন দেওয়া হয়, ২০২৪ সালে যার বাস্তবায়ন কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য ৪৭৩.৭৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। তবে অনুমোদনের দুই বছর পরেও বৈদেশিক অর্থায়নের মন্থর অবস্থার কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু করা যায়নি।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণের আওতায় ছয়টি জাহাজ কেনার অনুমোদন দেয় সরকার। বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের মহাব্যবস্থাপক জামাল হোসেন তালুকদার জানান, কবে এই ঋণচুক্তি হবে সেটি তিনি জানেন না।
ছয়টি টিভি স্টেশন স্থাপনের জন্য ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ চীনের অর্থায়নে আরেকটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয় সরকার। তবে পাঁচ বছর পরেও ১২৫.১২ মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি সম্পন্ন হয়নি।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রকল্পটির গুরুত্ব কমেছে। এই কারণে প্রকল্পটি আদৌ বাস্তবায়ন হবে কিনা– তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
এদিকে কার্গো হ্যান্ডলিং বাড়িয়ে মোংলা বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। চলতি বছরের ১২ সেপ্টেম্বর চীনা অর্থায়নে মোংলা বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের জন্য ৪ হাজার ২৮৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। ২০২৭ সালের মধ্যে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ শেষ করার কথা থাকলেও, কবে নাগাদ বাস্তবায়ন কাজ শুরু করা যাবে জানে না মোংলাবন্দর কর্তৃপক্ষ।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য এ কে এম আনিসুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সম্মতি পাওয়া গেলেই ইআরডির মাধ্যমে চায়না এক্সিম ব্যাংকের কাছে ঋণ প্রস্তাব পাঠানো হবে।
এ ছাড়া, আখাউড়া থেকে সিলেট সেকশনে মিটারগেজ রেলপথকে ডুয়েল গেজে রূপান্তর করার প্রকল্পটি চীনের ১,২৭২.৯৩ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সালের এপ্রিলে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশে এই প্রকল্পের ব্যয় পর্যালোচনা করে তা কমানো হয়। এ অবস্থায়, এই প্রকল্পে শেষপর্যন্ত চীনের সঙ্গে ঋণচুক্তি হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশের মোট চীনা ঋণের স্থিতি
ইআরডির তথ্যমতে, ৩০ জুন পর্যন্ত বহুপাক্ষিক এবং দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন অংশীদারদের কাছে বাংলাদেশের মোট ঋণের স্থিতি (আউটস্ট্যান্ডিং) ছিল ৬২.৩১ বিলিয়ন ডলার। এরমধ্যে চীনের অংশ ৫.৩৭ বিলিয়ন ডলার, যা মোট ঋণের ৮.৬২ শতাংশ। বাংলাদেশের ঋণের স্থিতিতে চীনের অবস্থান চতুর্থ।
বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা- ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ) স্বল্প-সুদে ঋণ দেয়। বাংলাদেশকে দেওয়া তাদের ঋণের স্থিতি ১৯.৫৩ বিলিয়ন ডলার, যা মোট পরিমাণের ৩১.৩৪ শতাংশ। তারপরেই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণের স্থিতি ১৪.১১ বিলিয়ন ডলার, বা মোট অংকের ২২.৬৫ শতাংশ। এরপর জাপানের রয়েছে ১০.৯৯ বিলিয়ন ডলার, যা মোট স্থিতির ১৭.৬৫ শতাংশ।
চীনের ঋণের ধরন ও সুদহার
চীন সরকার সাধারণত দু'ধরনের ঋণ দেয়, এর একটি হলো- মার্কিন ডলারে প্রেফারেন্সিয়াল বায়ার্স ক্রেডিট (পিবিসি) এবং অপরটি হলো– চীনের নিজস্ব মুদ্রায় গভর্নমেন্ট কনসেশনাল লোন (জিসিএল) বা সরকারিভাবে দেওয়া রেয়াতি ঋণ।
উভয় ধরনের ঋণের সুদহারই ২ শতাংশ, যা বিশ্বব্যাংক ও এডিবির সুদহারের কাছাকাছি। এর সাথে কমিটমেন্ট ফি যুক্ত হয় আরও শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ।
আইডিএ'র ঋণে সুদহার ১.২৫ শতাংশ, এর সাথে সার্ভিস চার্জ যোগ হয় শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ। জাপানের দ্বিপাক্ষিক ঋণের সুদহার সবচেয়ে কম, বা ১.৬ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের কিছু ঋণের সুদহার আবার বাজার-ভিত্তিক, যা বর্তমানে ৫ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের দুই-তৃতীয়াংশ ঋণের সুদহার হচ্ছে বাজার-ভিত্তিক।