বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি ১,১৭০ শতাংশ বেড়েছে, কিন্তু কমেছে অর্থছাড়
বাংলাদেশকে দেওয়া বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি পৌঁছেছে নতুন উচ্চতায়, যদিও অর্থছাড় কমছে এবং ঋণ পরিশোধের চাপও ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রদত্ত তথ্যে এ চিত্র উঠে এসেছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে, আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বাংলাদেশকে দেওয়া বৈদেশিক ঋণ প্রতিশ্রুতি ১ হাজার ১৭০ শতাংশের মতোন ব্যাপক হারে বেড়ে ৫.৮৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। দেশকে আরও আর্থিক সহায়তা দিতে উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে আস্থা রয়েছে– এ ঘটনা তারই ইঙ্গিত দেয়।
অন্যদিকে, বিদেশি ঋণছাড় পড়তির দিকে রয়েছে, একইসময়ে বেড়েছে ঋণ পরিশোধের ব্যয়। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ যখন কমছে, তার ওপর এটি আরও চাপ তৈরি করছে। এতে আন্তর্জাতিক পেমেন্টে স্থিতিশীল ব্যালান্স রাখা আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে।
ইআরডির তথ্যে প্রকাশ, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে বিদেশি ঋণের অর্থছাড় ১৪ শতাংশ বেড়ে ২.১২ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। সে তুলনায়, ঋণ পরিশোধের ব্যয় বেড়েছে ৫১ শতাংশ, একইসময়ে যা পৌঁছেছে ১.৩৩ বিলিয়ন ডলারে।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, ঋণ গ্রহণের জন্য যে সব প্রক্রিয়ার মধ্যে দিতে যেতে হয়, এবার সে প্রস্তুতি ভালো ছিল। এ কারণে এই অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে অনেক প্রকল্পের ঋণচুক্তি করা সম্ভব হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে প্রস্তুতির অভাবে শুরুর দিকে অনেক প্রকল্পের ঋণচুক্তি করা সম্ভব হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করছেন, প্রতিশ্রুতি বাড়ার ঘটনা আশাপ্রদ হলেও– আসল পরীক্ষা হবে কতোটা কার্যকরীভাবে এসব তহবিল বিনিয়োগ হবে– তার ওপর।
তিনি বলেন, উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি হিসেবে নতুন প্রকল্পে অর্থায়ন নিশ্চিত হয়েছে। সরকারি বিনিয়োগে এসব নতুন প্রকল্পে কতটুকু প্রভাব ফেলবে– তা নির্ভর করছে বাস্তবায়নকারী সংস্থার এই অর্থ ব্যয়ের জন্য প্রস্তুতির ওপর। আমাদের দেশের প্রকল্প বাস্তবায়নের মন্থর গতিতে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি, যে বাস্তবতা উন্নয়ন সহযোগীরাও এখন বুঝে গেছে। তাই প্রতিশ্রুতি মানেই অর্থছাড় না; এখানে বাস্তবায়ন সক্ষমতা বাড়ানোই হচ্ছে অর্থছাড়ের মূল চাবিকাঠি।
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ আরও মন্তব্য করেন, "গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টির সমাধান না করতে পারলে, প্রতিশ্রুত অর্থ পাইপলাইনেই পরে থাকবে এবং আমাদের উন্নয়ন কোনো ভূমিকা রাখবে না।"
প্রতিশ্রুতি বাড়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "আমরা দেখছি সাম্প্রতিক সময়ে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ, কৃষি সহায়তা ও সামাজিক সুরক্ষার খাতগুলো। এবং এসব প্রকল্পে ঋণ প্রক্রিয়াও দ্রুত হচ্ছে। মারাকেশ জলবায়ু সম্মেলনের পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঘোষণায়, বাংলাদেশের জলবায়ু সংক্রান্ত প্রকল্পে অর্থায়নে জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি ডেভেলপমেন্ট প্ল্যাটফর্ম করা হয়েছে। এখানে বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থাকে জলবায়ু-সংক্রান্ত অর্থায়নের কথা বলা হয়েছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্রকল্পের কারণে উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুতি লক্ষণীয়ভাবে বাড়ছে বলে ধারণা করা যায়।"
ইআরডির প্রাক্কলন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে ১০.২ বিলিয়ন ডলার প্রতিশ্রুতি আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে। এরমধ্যে অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে ৫৭.৩ শতাংশ প্রতিশ্রুতি আদায় হয়েছে। গত অর্থবছরের বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ৮.৭৯ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল।
অর্থছাড় কেন কমেছে?
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, বাস্তবায়ন সক্ষমতার অভাবে সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো যথাসময়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে না। যা অর্থছাড়ও আটকে যাওয়ার মূল কারণ। বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় বাড়াতে প্রতিবছরই বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রতিবছরের মতো এবারও এডিবি, বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)সহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে ইআরডি ও বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর ত্রি-পক্ষীয় সভা হচ্ছে। সেখানে প্রকল্প বাস্তবায়নে জটিলতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু, তারপরও বিভিন্ন অনেক প্রকল্পের অর্থছাড় আটকে আছে কিংবা অর্থছাড়ে গতি নেই।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে. মুজেরি টিবিএসকে বলেন, বৈদেশিক ঋণ প্রকল্পে কিছু কঠোর শর্ত থাকে, এসব শর্ত মেনে প্রকল্প বাস্তবায়ন সক্ষমতার অভাব রয়েছে সরকারি সংস্থাগুলোর। গতানুগতিক এই ধারার সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিও– উন্নয়ন প্রকল্পে বাস্তবায়নে প্রভাব ফেলেছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে এখন সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতে ঢিমেতালে কাজ হচ্ছে, যা প্রকল্পের কার্যকরী বাস্তবায়নকে ব্যাহত করছে।
এ ছাড়া, আমাদের অর্থনৈতিক সংকট– বিশেষত উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভ সংকটের কারণে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার গতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এতে বৈদেশিক ঋণের অর্থছাড় কমেছে বলেও জানান তিনি।
ইআরডি'র তথ্যে ঋণের অর্থছাড়ে পড়তি দশা ফুটে উঠেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীরা রেকর্ড ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড় করেছিল। সে তুলনায়, গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) এ অর্থছাড় হয়েছে ৯.২৬ বিলিয়ন ডলার। তারপরেও চলতি অর্থবছরে ১১.২ বিলিয়ন ডলার অর্থছাড়ের লক্ষ্য রয়েছে।
ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে
এদিকে বেশকিছু বড় প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়া, সুদহার বৃদ্ধি এবং বিশ্ববাজারে অর্থনৈতিক গতিমন্থরতার কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে।
ইআরডি'র কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায়– বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের মতো বড় প্রকল্পগুলোর জন্য আসল পরিশোধ শুরু হয়েছে, ঋণ পরিশোধের ব্যয় বাড়ার যা মূল কারণ।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে– বৈদেশিক ঋণের আসল পরিশোধ ২০ শতাংশ বেড়েছে – আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায়।
অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই সরকারের বাজার-ভিত্তিক ঋণ এবং সেগুলোর ভাসমান সুদহারও বেড়েছে।
দুই বছর আগেও বাজার-ভিত্তিক ঋণে সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট (সোফর) সুদহার ১ শতাংশের কম ছিল, যা এখন ৫ শতাংশ বেড়েছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপকে যা আরও তীব্র করেছে। ফলে চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে সুদ পরিশোধ ১৩৬.৫ শতাংশ বেড়েছে আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে।
কার কাছে কত প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড় পেয়েছে বাংলাদেশ?
অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে মূলত তিন উন্নয়ন সহযোগী কাছ থেকেই বেশি প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশ। এর সর্বোচ্চ ২.০৬ বিলিয়ন ডলার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে এডিবির কাছ থেকে। এ ছাড়া জাপানের কাছ থেকে এসেছে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি। ১.৪১ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিশ্বব্যাংক ।
অন্যদিকে, জুলাই-নভেম্বর সময়ে সবচেয়ে বেশি অর্থছাড় করেছে জাপান। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) এ সময় ছাড় করেছে ৬১০.৯৮ মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া, এডিবি ৪৪৪.২৭ মিলিয়ন, রাশিয়া ৪৯৩.৯৬ মিলিয়ন এবং বিশ্বব্যাংক ৩৮৭.৯৩ মিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে।