কীভাবে একটি ছোট প্রতিষ্ঠান দুর্যোগে লাখো জাপানিকে আগাম সতর্ক করেছিল?
ইংরেজি নববর্ষের দিনে জাপানের প্রত্যন্ত নোটো উপদ্বীপে যখন ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে, তখন ছোট্ট একটি কোম্পানি লাখো জাপানিকে ভূমিকম্প সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়।
এনইআরভি (নার্ভ), গেহির্ন নামে একটি ছোট প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত হয়। জার্মান ভাষায় যার অর্থ মস্তিষ্ক। জাপানে ঘন ঘন ভূমিকম্পের সতর্কতার ক্ষেত্রে এটি প্রায়শই সরকারি সংস্থা এবং দেশের পাবলিক ব্রডকাস্টার এনএইচকের জারি করা সতর্কতার চেয়ে দ্রুত সংবাদ পৌঁছে দেয়।
এক্স (প্রাক্তন টুইটার)-এ এনইআরভির জাপানি ভাষার অ্যাকাউন্টের ২.২ মিলিয়ন অনুসারী রয়েছে। আরও ৩৫ হাজার নেটিজেন ইংরেজি সংস্করণটি ব্যবহার করে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে চালু হওয়া এই অ্যাপটি অ্যাপল স্টোর এবং গুগল প্লে উভয় থেকে চার মিলিয়নেরও বেশি বার ডাউনলোড করা হয়েছে। এটি ২০১০ সালে ১৯ বছর বয়সী দাইকি ইশিমোরি একটি অ্যাকাউন্ট হিসেবে তৈরি করেছিলেন।
২০১১ সালের ভূমিকম্প এবং সুনামির পর থেকে দুর্ঘটনা সম্পর্কিত তথ্যের জন্য জাপানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স জনপ্রিয়। ভূমিকম্প, সুনামি এবং আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত সম্পর্কিত রিয়েল-টাইম তথ্য সরবরাহ করার পাশাপাশি এনইআরভি টাইফুন, বন্যা ও ভারী তুষারপাতের মতো চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলোর আপডেটও সরবরাহ করে।
অ্যাকাউন্টটি প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো পর্যবেক্ষণ করে এমন বেশ কয়েকটি সংস্থার ডেটা সংগ্রহ করে টুইট করে। প্রায়শই অ্যাকাউন্টটি ঐ সংস্থাগুলোর চেয়েও দ্রুত তথ্য প্রকাশ করে থাকে।
ইশিমোরি বলেন, এনইআরভি (নার্ভ) জনপ্রিয় অ্যানিমে টিভি শো 'নিয়ন জেনেসিস ইভাঞ্জেলিয়ন' দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। অ্যানিমেটি কেয়ামত পরবর্তী সময়কার পৃথিবীর ধারণার ওপর নির্মিত; যেখানে অর্ধেকেরও বেশি মানুষ মারা যায়।
তাই অ্যাকাউন্টটির নাম দেওয়া হয়েছে 'স্পেশাল সার্ভিস এজেন্সি এনইআরভি' অর্থাৎ এটি মানবজাতির জন্য হুমকি সম্পর্কে সতর্কতা জারি করে।
ইশিমোরি বিবিসিকে বলেন, "আমি প্যারোডি অ্যাকাউন্ট হিসেবে এনইআরভি তৈরি করেছি। কারণ টুইটার তখন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল। জাপান আবহাওয়া সংস্থার তথ্য ব্যবহার করে আবহাওয়া সতর্কতা সম্পর্কে স্বয়ংক্রিয় টুইট পোস্ট করা আমার প্রোগ্রামিং-এর শখ হিসেবে শুরু হয়েছিল।"
ওই সময় ইশিমোরির অ্যাকাউন্টে মাত্র তিনশো জন অনুসারী ছিল। কিন্তু ২০১১ সালে জাপানের রেকর্ড শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভূমিকম্প পরবর্তী সুনামিতে ফুকুশিমা পারমাণবিক চুল্লির দুর্ঘটনাসহ, দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মিয়াগির ইশিনোমাকি শহরেও ব্যাপক প্রাণহানি ঘটায়।
চারদিন ধরে মি. ইশিমোরি তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। তিনি বলেন, "সত্যি কথা বলতে, আমি ভেবেছিলাম তারা নিশ্চিত মারা গেছেন।"
পরে অবশ্য তিনি জানতে পারেন যে, তারা নিরাপদে থাকলেও তার এক খালা মারা গেছেন। তিনি বলেন, "আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে, দুর্যোগের তথ্য প্রাপ্তির জন্য কেবল টিভি কিংবা রেডিও নয়, আমাদের অন্যান্য উপায়ও থাকা দরকার।" কারণ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ওই সময় টিভি অকেজো হয়ে পড়েছিল
এরপর ইশিমোরি ভূমিকম্প সম্পর্কে পোস্ট করা শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে জাপানে আরও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হওয়ার সাথে সাথে তার অ্যাকাউন্টটিতেও লাখ লাখ নতুন অনুসারী যুক্ত হওয়ায় শুরু হয়।
একইসাথে এক্স-এর সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলো ইংরেজি নববর্ষের দিনের ভূমিকম্পের সময় এনইআরভিতে প্রভাব ফেলেছিল। গত বছর, এক্স তার অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (এপিআই) অ্যাক্সেস করার জন্য ব্যবহারকারীদের চার্জ করা শুরু করে। যা প্ল্যাটফর্মটিকে বাহ্যিক সিস্টেমের সাথে সংযুক্ত করে এবং এতে স্বয়ংক্রিয় পোস্ট দেওয়ার অনুমতি দেয়।
প্ল্যাটফর্মের এপিআই আগে ব্যবহারের জন্য বিনামূল্যে ছিল। তবে এখন কেবল মাসে ১৫০০টি স্বয়ংক্রিয় পোস্ট বিনামূল্যে দেওয়া যায়।
গেহির্ন একটি মৌলিক পরিকল্পনা ব্যবহার করে। এতে প্রতি মাসে একশ মার্কিন ডলার খরচ করে প্রতিদিন একশটি পোস্টের অনুমতি দেয়। সাম্প্রতিক ভূমিকম্প সতর্কতার সময়, এনইআরভি এই সীমায় পৌঁছে যায়, যার ফলে অনুসারীরা তার অ্যাপ্লিকেশনটি ডাউনলোড করতে শুরু করে।
যদিও এক্স পরবর্তীতে অ্যাকাউন্টগুলোকে 'পাবলিক ইউটিলিটি' হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করে সমস্যার সমাধান করেছিল। তবুও ভূমিকম্পের সময় অ্যাকাউন্ট লকের কারণে এনইআরভি ২০১৯ সালে প্ল্যাটফর্ম থেকে স্থানান্তর শুরু করে।
ইশিমোরি বলেন, "আমরা যদি অন্যদের প্ল্যাটফর্মে থাকি, তাহলে তাদের নিয়ম হঠাৎ করে পরিবর্তিত হতে পারে। তাই আমরা আমাদের নিজস্ব প্ল্যাটফর্মে ফোকাস করতে চাই।"
ইশিমোরি জানান, তার লক্ষ্য সব সময় 'জাপানকে নিরাপদ করা', অর্থ উপার্জন নয়। তিনি এনইআরভি অ্যাপ্লিকেশনটিকে যতটা সম্ভব ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে চান; এমনকি প্রতিবন্ধীদের জন্যও।
তবে মি. ইশিমোরি মনে করেন, অ্যাপ্লিকেশনটি বড় হওয়ার সাথে সাথে তার সংস্থাকে অর্থের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে সংস্থাটি তার ব্যয় বহন করার জন্য ২০২০ সালে 'সাপোর্টার্স ক্লাব বা সমর্থকদের ক্লাব' নামে একটি পেইড মেম্বারশিপ স্কিম চালু করে। যার মাধ্যমে বর্তমানে বছরে প্রায় ১২০ মিলিয়ন ইয়েন বা সাড়ে ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে।
মি. ইশিমোরি জানান, তারা এখনও লাভজনক অবস্থায় পৌঁছাননি। প্রায় এক তৃতীয়াংশ ব্যয় এখনও সমর্থকেরা বহন করেন। তিনি অনেকটা হাসতে হাসতে বলেন, "আমরা যত বেশি তহবিল পাই, তত বেশি নতুন তথ্য আমরা কিনি। তাই আমরা এখনও অলাভজনক অবস্থায় আছি।"
মি. ইশিমোরি জানান, ২০১১ সালে তার খালাকে সাহায্য করতে না পারার অপরাধবোধ এখনও তাকে কষ্ট দেয়। তিনি বলেন, "আমরা জানি, আবারও বড় ভূমিকম্প ও সুনামি হবে। তাই আমার লক্ষ্য হল দুর্যোগের তথ্যের ব্যবহারযোগ্যতাকে আরও উন্নত করা। যাতে ভবিষ্যতে প্রয়োজনের সময় সহজেই সবাই এর সুবিধা গ্রহণ করে জীবন রক্ষা করতে পারে।