'বিপ্লবের প্রতীক' কেফিয়াহ তৈরি করে যাচ্ছে উদ্যমী ফিলিস্তিনি ফ্যাক্টরি
অধিকৃত পশ্চিম তীরের হেবরন শহরে অবস্থিত 'হারাবু ফ্যাক্টরি'। পুরো ফিলিস্তিনে এই কারখানাটিই একমাত্র জায়গা যেখানে 'ফিলিস্তিনি কেফিয়াহ' তৈরি করা হয়। এই বিষয়ে আরও নিশ্চিত হওয়া যায় কারখানাটির ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলে।
এই কেফিয়াহ কারখানার মালিক, ইজ্জাত, আব্দুল্লাহ এবং জৌদা, তিন হারাবু ভাই। কারখানাটিতে তারা কাজ শুরু করেছিলেন সেই ছোটবেলায়। তাদের বাবা হাজ্জ ইয়াসার এই কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯৬১ সালে। তার হাত ধরেই কাজ শিখেছিলেন তার তিন ছেলে।
হাজ্জ ইয়াসার ব্যবসায়ী থেকে হয়ে উঠেন উদ্যোক্তা। প্রথমে সিরিয়া থেকে কেফিয়াহ নিয়ে এলেও পরে তিনি জাপান থেকে দুটো তাঁত এনে নিজের কারখানা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। হাজ্জ ইয়াসার 'কেফিয়াহ'র ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিলেন।
কেফিয়াহ ফিলিস্তিন ভূমিতে কোনো ফিলিস্তিনি নাগরিকের হাতে তৈরি হওয়ার যে গুরুত্ব এবং একইসাথে কেফিয়াহ নিজে যে অর্থ বহন করে তা তিনি এবং তার তিন ছেলেরা সমগ্র ফিলিস্তিনেই ছড়িয়ে দিয়েছেন।
আল জাজিরাকে হারাবু ভাইয়েরা বলেন, "আমরা খুশি। আমরা আমাদের কাজকে ভালোবাসি। তা সে যত দীর্ঘ সময়ই হোক বা যত কঠিনই হোক।"
হারাবু ভাইয়েরা ছাড়া আরও আছেন আব্দুল আজিজ আল বারাকি। তিনি ১৫ বছর বয়স থেকে হাজ্জ ইয়াসারের সাথে কাজ করেন। ৭০ বছর বয়সেও আজও তিনি প্রতিদিন সকালে তাঁতে কাজ করতে বসেন। আর দিনের সব কিছুর প্রস্তুতি তদারকি করেন তিনি।
২০ টি তাঁতের এই কারখানাটি নিয়ে গর্ব করেন আল বারাকি। তিনি জানান, তাঁতের আওয়াজের সাথে তিনি অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। প্রতিটা যন্ত্রের প্রতিটা অংশ সম্পর্কে জানেন। তিনি আল জাজিরাকে জানান, তিনি অবসরে যেতে চান না।
"আমি শুধু এই কাজ করে যেতে চাই। এই কাজটাকে খুবই ভালোবাসি আমি। যারা এই কেফিয়াহ কিনবে তাদের কাছে এর যে মাহাত্ম্য, আমার কাছেও এর মাহাত্ম্য সমান", আবেগী গলায় এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন আল বারাকি।
তরুণ থেকে বৃদ্ধ, যেকোনো বয়সী কিংবা যেকোন ধরনের মানুষের কাছে জনপ্রিয় কেফিয়াহ। কেউ ওড়না হিসেবে, তো কেউ মাথা ঢাকতে ব্যবহার করে কেফিয়াহ। তবে এটি কিন্তু শুধু এক টুকরো কাপড় নয়। কেফিয়াহ বহন করে গভীর অর্থ। এর সাথে জড়িয়ে আছে ফিলিস্তিনি পরিচয়। তাই অনেকেই এটিকে তাদের পতাকার সাথে তুলনা করে।
এখানকার কেফিয়াহতে উন্নতমানের সুতা ব্যবহার করা হয়। সেক্ষেত্রে এগুলো তৈরিতে সুতাকে ভালোভাবে রঙ করে বেশি 'থ্রেড কাউন্ট' দিয়ে বানানো হয় বলে জানান হারাবু ভাইরা।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার 'সস্তা' কেফিয়াহতে সয়লাব হয়ে গেলেও হারাবু ভাইয়েরা মনে করেন যে, এসব বাজে মানের কেফিয়াহর সাথে লড়াই করে টিকে থাকবে তাদের উন্নত মানের কেফিয়াহ। তাদের মতে, ফিলিস্তিনি শিল্পের মান এবং 'মেইড ইন প্যালেস্টাইন' লেবেলের ক্ষমতাই টিকিয়ে রাখবে তাদের এই শিল্পকে।
তরুণরা এই কেফিয়াহ পরে ইসরায়েলের সাথে চলমান সংঘাতে 'বিপ্লবের প্রতীক' হিসেবে। হারাবুদের ঐতিহ্যবাহী কেফিয়াহতে উঠে আসে ফিলিস্তিনের মানুষের জীবনযাপন। একইসাথে অধ্যাবসায়, শক্তি এবং সহনশীলতা প্রতীক অলিভ গাছের পাতা; মাছের জালের প্যাটার্ন ব্যবহার করা হয় সমুদ্রের কাছাকাছি ভূমি এবং মাছ ধরার ঐতিহ্যকে প্রকাশ করতে। মোটা দাগগুলো হলো বাণিজ্যের যাত্রাপথ আর চিকন দাগগুলো দেওয়া হয় ফিলিস্তিনের দীর্ঘ সময়ের ইতিহাসকে বোঝাতে।
কেফিয়াহ মূলত সাদা-কালো হলেও এখন নানা রঙের পাওয়া যায়। হারাবুরা বলেন, "আমরা প্রায় ৩০০ এরও বেশি ধরনের কেফিয়াহ বানিয়ে থাকি। যা তরূণদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়।"
হারাবুদের যে ধরনের কেফিয়াহ সবচেয়ে বেশি প্রচলিত তা হলো সাদা, কালো এবং লাল। এর মধ্য দিয়ে সম্মান জানানো হয় জর্ডানকে। দেশটি সবচেয়ে বেশি ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে।
গাজাতে বর্তমানে চলমান ইসরায়েলি যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে কেফিয়াহর চাহিদা আকস্মিকভাবে বেড়ে গেছে। বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ ফিলিস্তিনিদের সাথে সংহতি জানাতে কেফিয়াহকে বেছে নিচ্ছেন। কিন্তু ইসরায়েল, পশ্চিম তীরের সাথে অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে রাখায় কেফিয়াহ রপ্তানি বাড়াতে পারছে না তারা।
বর্তমানে ৮৭ বছর বয়সী ফাথী-আল-জেবরিনি ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত সবসময় কেফিয়াহ পড়তেন। হেবরণের পুরোনো শহরের এই দোকানদার খাবার বিক্রি করেন। নিজের দোকানে পৌছাতে তার সাক্ষাৎ হয় অসংখ্য মানুষের সাথে। সবাই তার পরিচিত। এদের সবার পোশাকেই আছে কেফিয়াহ।
তিনি আল জাজিরাকে বলেন, কেফিয়াহ পরার ঐতিহ্য চলে এসেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। এটি আসলে আমাদের পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে গিয়েছে।
তার দোকান থেকে কিছুদূর যেতেই ৫৮ বছর বয়সী বদর-আল-দাউর আল-তামিমির দোকান। সেখানে দোকানের সামনে পসরা সাজিয়ে রেখেছেন কেফিয়াহসহ আরও অনেক ফিলিস্তিনি স্মারক দিয়ে। এগুলো বিক্রি হয় পর্যটকদের কাছে। আবার মাঝে মধ্যে রপ্তানিও করা হয়।
তিনি বলেন, কেফিয়াহ পরা ফিলিস্তিনের কাউকে সহ্য করতে পারে না ইসরায়েলি সৈন্যরা। তিনি নিজে দেখেছেন যে, হেবরন শহরের কেফিয়াহ পরার অপরাধে তরূণদের আক্রমণ করে কেফিয়াহ খুলে নিয়েছে ইসরায়েলি সৈন্যরা।
হারাবুদের কাছে এই কাজ তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় হলেও জাতীয়ভাবে এর গুরুত্ব অনেক। এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতেই তাই তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম যুক্ত হয়েছেন কেফিয়াহ বানানোর পেশার সাথে।
তারা মনে করেন যে, এই কেফিয়াহ শুধু অর্থ উপার্জনের খাতই নয়। বরং কেফিয়াহ অক্ষুণ্ণ রেখেছে ফিলিস্তিনের ঐতিহ্যকে।