গাজা থেকে বের হতে মরিয়া ফিলিস্তিনিদের ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত ঘুষ দিতে হচ্ছে
মিশরের রাফাহ সীমান্ত দিয়ে গাজা থেকে বের হতে মরিয়া বহু ফিলিস্তিনিরা। আর এতে দালালদের ১০ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত ঘুষ দিতে হচ্ছে। গার্ডিয়ানের এক তদন্তে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। আর এই কাজে জড়িত রয়েছে মিশরীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাথে কথিত যোগসূত্র থাকা মধ্যস্বত্বভোগী এবং কুরিয়ারদের নেটওয়ার্ক। মূলত 'সমন্বয় ফি' এর নাম করেই তারা এই বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত এক ফিলিস্তিনি নাগরিক জানায়, রাফাহ সীমান্ত দিয়ে তার স্ত্রী ও সন্তানদের গাজা থেকে বের করতে তিন সপ্তাহ আগে তাকে ৯ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়েছে। পরিবারটি গত ৯ অক্টোবরের হামলার পর থেকে একটি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
এক্ষেত্রে সীমান্ত পাড়ির দিন জানানো হয়, তালিকায় তার সন্তানদের নাম নেই। এজন্য তাকে অতিরিক্ত ৩ হাজার ডলার করে দিতে হবে। এমন আচরণকে মধ্যস্বত্বভোগীদের গাজাবাসীর 'রক্ত নিয়ে ব্যবসা' করার চেষ্টা বলে মনে করেন তিনি।
ঐ ফিলিস্তিনি বাবা বলেন, "এটা খুবই হতাশাজনক এবং দুঃখজনক। তারা এমন লোকদের শোষণ করার চেষ্টা করছে যারা ভুগছে। যারা গাজার নরক থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে।"
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গাজার এখন প্রায় ৮৫ ভাগ লোক বাস্তুচ্যুত। ইসরায়েলি বিমান ও স্থল হামলার উপত্যকাটির মধ্য ও উত্তরাঞ্চল যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ গাজাবাসীকে প্রাণ বাঁচাতে দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফাহ শহরে আশ্রয় নিতে হচ্ছে।
গাজায় চলমান ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক দেশ হিসেবে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে প্রতিবেশী মিশর। দেশটি দীর্ঘকাল ধরে রাফাহ ক্রসিং খুলে দেওয়ার প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে। কেননা তাদের যুক্তি এই যে, এতে লাখ লাখ গাজাবাসী প্রতিবেশী সিনাই উপদ্বীপে চলে যাবে। কায়রোর দাবি, এতে করে তাদের নিজেদের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে।
মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসিও মনে করেন, গাজা থেকে উদ্বাস্তুদের ব্যাপক ঢল ফিলিস্তিনিদের জর্ডানে আশ্রয় নেওয়ার নজির স্থাপন করতে পারে।
কায়রোতে অবস্থিত মধ্যস্বত্বভোগী একটি নেটওয়ার্ক বছরের পর বছর ধরে রাফাহ সীমান্তের চারপাশে কাজ করছে। মূলত তারা ফিলিস্তিনিদের গাজা ছেড়ে যেতে সাহায্য করছে। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার তারা বেশি অর্থ নিচ্ছে।
গার্ডিয়ানের পক্ষ থেকে রাফাহ সীমান্ত পাড়ি দিতে চাওয়া বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলা হয়েছে। তারা জানায়, উপত্যকাটি ছেড়ে যেতে তাদের প্রত্যেককে ৫ থেকে ১০ হাজার ডলার দিতে হবে। এই অর্থ সংগ্রহের জন্য অনেকেই ক্রাউডফান্ডিং ক্যাম্পেইন শুরু করেছে। অন্যদের বলা হয়েছিল, তারা আরও বেশি অর্থ প্রদান করলে আরও তাড়াতাড়ি চলে যেতে পারবে।
রাফাহ ক্রসিংয়ের খবর প্রকাশ করা ফেসবুক পেজগুলোতে বহু ফিলিস্তিনি সীমান্ত পাড়ি দিতে চাওয়া অপেক্ষমাণ তালিকায় নিজেদের নাম যুক্ত করতে সাহায্যের আবেদন করছেন।
সাক্ষাৎকার নেওয়া প্রত্যেকেই বলেছেন, তারা গাজায় থাকা সূত্রের মাধ্যমে দালালদের সাথে যোগাযোগ করেছে। এক্ষেত্রে অর্থপ্রদান করা হয় নগদে, কখনও কখনও ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে।
গার্ডিয়ানকে এমনই এক চাঞ্চল্যকর তথ্য জানিয়েছে গাজা থেকে আসা বর্তমানের মার্কিন নাগরিক বেলাল বারউড। তাকে ১১ টি পরিবারকে রাফাহ সীমান্ত পাড়ি দিতে মোট ৮৫ হাজার ডলার জোগাড় করতে বলা হয়েছে। যে পরিবারগুলোর মধ্যে তিন বছরেরও কম পাঁচ জন সন্তান রয়েছে।
বেলাল নিজেও গত ৩ মাস ধরে ঘুরছেন মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট টাস্কফোর্সের কাছে। তার আর্জি, ডায়াবেটিকসে ভুগতে থাকা তার বাবাকে যেন গাজা থেকে বের হতে চাওয়া অপেক্ষমাণ শরণার্থীদের তালিকায় রাখা হয়।
সেটিতে ব্যর্থ হয়ে বেলাল বলেন, "আমি শুধু এই বিকল্পটি বিবেচনা করছি কারণ মার্কিন সরকার আমার অনুরোধে সাড়া দিচ্ছে না। আমার বাবার বিষয়টি নিয়ে যদি অন্য কোনো পথ খোলা থাকতো তবে আমি এই পথে হাঁটতাম না। আমি এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি কারণ যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব নাগরিকদের সাহায্য করছে না।"
বেলালের ৭০ বছর বয়সী বাবাকে গত ডিসেম্বরে ইসরায়েলি বাহিনীর আটক করেছিল। আটকের পর অন্তর্বাস খুলে ফেলা একটি দলের যে খবরটি গণমাধ্যমে এসেছিল, সেই দলেই ছিল তার বাবা। আটককৃতদের হাতে জিপ বাঁধা ছিল এবং তাদেরকে একটি গোপন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
এমনকি তার বাবার আটকের আগেও বেলাল কয়েক সপ্তাহ ধরে সাহায্য চেয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে তিনি ওয়াশিংটন বা জেরুজালেমে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে ফোনে করে ঘন্টার পর ঘণ্টা সময় অনুরোধ করেছিলেন। একইসাথে স্টেট ডিপার্টমেন্টে একের পর এক তথ্য জানিয়ে মেইল করেছিলেন।
মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের পলিসিতে প্রাথমিকভাবে বলা হয়েছিল যে, এটি শুধুমাত্র মার্কিন নাগরিকদের অবিলম্বে গাজা থেকে বেরিয়ে যেতে সহায়তা করবে। কিন্তু পরবর্তীতে জানায়, এটি একইসাথে মার্কিন নাগরিকদের পিতামাতা ও ভাইবোনদের বের করতেও সাহায্য করবে।
বেলাল বলেন, "ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে আমি তাদের কাছ থেকে কোনো ইমেইল পাইনি। আমি মোট ছয়বার ফলো-আপ করেছি। এক্ষেত্রে তারা শুধুমাত্র ইমেলের মাধ্যমেই যোগাযোগ করে থাকে। অন্যদিকে আমি দেখেছি যে, টাকা দেওয়া লোকেরা এক বা দুই দিনের মধ্যেই বেরিয়ে যেতে পারছে।"
অন্যদিকে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানায়, তারা পৃথক কোনো ঘটনার ক্ষেত্রে মন্তব্য করবে না। তবে একজন মুখপাত্র বলেন, কিছু মধ্যস্বত্বভোগী লোক যে গাজা থেকে মানুষজনকে বের করার ক্ষেত্রে অর্থ নিচ্ছে, সে সম্পর্কে তারা অবগত নয়।
স্টেট ডিপার্টমেন্ট জানায়, "আমরা ১৩০০ জনেরও বেশি মার্কিন নাগরিক, মার্কিন বৈধ স্থায়ী বাসিন্দা এবং পরিবারের সদস্যদের গাজা থেকে বের হতে সহায়তা করেছি।"
সিনাই উপদ্বীপ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ এবং 'সিনাই: ইজিপটস লিঞ্চপিন, গাজাস লাইফলাইন, ইসরায়েলস নাইটমেয়ার' বইয়ের লেখক মোহান্নাদ সাবরি জানান, রাফাহ বর্ডারের দালারেরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলোকে টার্গেট করে থাকে।
সাবরি বলেন, "কোনো পরিবারের কোনো সদস্য আহত বা অসুস্থ থাকলে তাদের পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। তাদেরকেই নিখুঁতভাবে ভিক্টিম বানানো হয়। তারা নিজেদের পরিবারকে নিয়ে আসতে যে কোনো পরিমাণ অর্থেই রাজি হয়ে যায়। এটা একটা সম্পূর্ণ র্যাকেট।"
সীমান্ত না খোলার ক্ষেত্রে মিশরীয় কর্তৃপক্ষের জনসাধারণের কাছে যে যুক্তি সেটি সাবরি মানতে নারাজ। বরং তিনি এর পেছনে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। মিশরের স্টেট ইনফরমেশন সার্ভিসের প্রধানের সাথে গার্ডিয়ানের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও তিনি এই বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সাবরি বলেন, "এটি নিম্ন স্তরের দুর্নীতি নয়। বরং এটি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংগঠিত সক্রিয় দুর্নীতি।"
গাজা থেকে বেরিয়ে আসার খুব কম উপায়ই রয়েছে। বিশেষ করে যাদের অন্য দেশের নাগরিকত্ব নেই। সেক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিদের ও বিদেশে থাকা তাদের আত্মীয়দের মধ্যস্বত্বভোগী নেটওয়ার্কের উপর আস্থা রাখা ছাড়া খুব বেশি বিকল্পও নেই।
যুক্তরাজ্যে বসবাসরত এক ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিজের পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন। তিনি বলেন, "মানুষ অন্যের দুঃখকে পুঁজি করে অর্থ উপার্জন করছে। তারা ঐসব মানুষদের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করার পরিবর্তে বরং অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করছে। যদি লোকেদের বের করে আনার উপায় থেকেই থাকে তবে কেন তারা সাহায্য করবেন না?"
এক ফিলিস্তিনি জানান, তার পরিবারের নয়জন যুবক পুরুষদের প্রত্যেককে ডিসেম্বরের শুরুতে বের হতে সাহায্য করতে ৪ হাজার ডলার করে খরচ হবে বলে জানানো হয়েছিল। এখন নেটওয়ার্কটি ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার ডলার দাবি করছে। মূলত ব্রিটিশ সরকার বা মানবিক সংস্থার কাছ থেকে সাহায্য পেতে ব্যর্থ হয়ে পরিবারটি মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে যেতে বাধ্য হয়।
ঐ ফিলিস্তিনি বলেন, "আমি নিশ্চিত নই যে, কেন কোনও স্কিম চালু করা হয়নি! লোকেদের সরিয়ে নেওয়ার মতোও কোনো উদ্যোগও নেই। আমি এমনকি মানবতার বিচারেও এই বিষয়ে আর কথা বলতে শুনছি না।"
এই ফিলিস্তিনি অনেকটা অনুযোগের সুরে বলেন, "বিষয়টা অনেকটা এমন যে, 'আমরা আপনাকে রক্ষা করতে যাচ্ছি না কিংবা নিরাপত্তা দিতে যাচ্ছি না। আমরা আপনাকে শুধু কিছু খাবার এবং পানি দেব যখন আপনি বোমা হামলায় ভুক্তভোগী হবেন।"
অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, তারা এখন পর্যন্ত ৩০০ জন ব্রিটিশ নাগরিক এবং তাদের স্বজনদের অগ্রাধিকার দিয়ে গাজা থেকে সরিয়ে নিয়েছে। যারা নাগরিকদের বাবা-মা কিংবা সন্তান৷
তবে সকলেই যে অর্থ দিতে রাজি হচ্ছে, বিষয়টি এমন নয়। এমনকি অনেকের সেই সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সেটা করছে না। পরিবারসহ গাজা থেকে বের হতে চাওয়া তেমনই এক ফিলিস্তিনি বলেন, "প্রতিটি মুহূর্ত আমার ও পরিবারের সদস্যদের জীবন হুমকিতে রয়েছে। তবে আমি এক টাকাও ঘুষ দেব না।"